সংবাদ প্রতিনিধি, মুর্শিদাবাদঃ রবিবার লোকসভা নির্বাচনের পর্যালোচনা বৈঠকে বসেছিল মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস। জেলা নেতাদের সঙ্গে ২৬টি ব্লকের নেতা ছাড়াও বিভিন্ন শহর কমিটির নেতারা ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন। দুপুর দেড়টায় সেই বৈঠক শুরু হয় মুর্শিদাবাদ জেলা কার্যালয়ে। লম্বা সময় ধরে চলা ওই বৈঠকে সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। সেই সভাতেই জেলায় একজন পূর্ণ সময়ের সভাপতি্র দাবি তুললেন বৈঠকে হাজির নেতাদের একাংশ।
ভেঙে যাওয়া কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়াতে করণীয় কী তা জানতেই মূলত এদিনের বৈঠকে বসেছিলেন জেলার কংগ্রেস নেতারা। দোষ পাল্টা দোষ ধরা নয়, আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি সারিয়ে মজবুত সংগঠন তৈরি করতে চাইছেন দলের একাংশ নেতা। এদিনের বৈঠকে নিজেদের সেই মত তুলে ধরেন তাঁরা প্রদেশ সভাপতির সামনেই। রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, মুর্শিদাবাদের ভোট ব্যাঙ্কে এখনও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি কংগ্রেস।
আরও পড়ুনঃ রানিনগরে ভোট পরবর্তী হিংসার জের…
কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদল এখনও এই জেলায় কংগ্রেসকে ‘সমীহ’ করে চলে। তবে তার সিংহভাগ কৃতিত্ব অধীর চৌধুরীর নিজের। তাঁকে ঠেলে সামনে দাঁড়াতে পারেননি এই জেলার অন্য কোনও নেতা। স্বাভাবিকভাবেই জেলায় কংগ্রেসের ভরকেন্দ্র সেই অধীরই। এবার সেই ভরকেন্দ্রেরও পরিবর্তন চাইছেন জেলার কেউ কেউ, ‘যা এখনই অসম্ভব’ বলছেন সেই তাঁরাই।
একদিকে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুভার অন্যদিকে প্রদেশের দায়িত্ব একই সঙ্গে নিজের গড় বাঁচানো। সবদিক সামলাতে গিয়ে তাঁর মুর্শিদাবাদেই কংগ্রেসের ভিত দূর্বল হয়েছে। সুযোগ নিয়েছে তৃণমূল। শেষ পর্যন্ত হারই হয়েছে ‘দাদা’র। বৈঠকে উপস্থিত এক ব্লক নেতাই বলছিলেন কথাগুলো। তিনি বলছেন, ” আমাদের এখানে এখন চাই একজন পূর্ণ সময়ের জেলা সভাপতি। ছাত্রদল নেই। যুবদের সামনে আনতে হবে। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষতায় ফেরাতে আমরাই পারব। তবে আমাদের ঘরে বসে থাকলে হবে না। রাস্তায় নামতে হবে। মানুষের মাঝে নামতে হবে। কীর্তনেও জেতে হবে , ইদে,মহরমেও যেতে হবে। জেলায় কংগ্রেস হারিয়ে যায়নি। একথা বোঝাতে হবে সমর্থকদের।”

তাঁরা চাইছেন “অধীর দা সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ঢেলে সাজান জেলা কংগ্রেস কমিটি।” কেউ কেউ চাইছেন, ” জেলা কমিটিকে ভেঙে জঙ্গিপুর ও বহরমপুর দু’ভাগে ভাগ করতে। দায়িত্ব দেওয়া হোক দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে।” কারও পরামর্শ “অধীরদা প্রদেশের দায়িত্বে থাকুন। এই মুহুর্তে তিনি ছাড়া তৃণমূল বিরোধী কোনও নেতা রাজ্যে নেই যিনি শাসকের বিরুদ্ধে তর্জন গর্জন করতে পারেন।
জেলায় নেতার ভাটায় যদি তেমন কাউকে দায়িত্বে আনা নাও যায় তাহলে দলের ভেতর থেকে দু-তিনজনকে সামনে আনা হোক। অধীর দা’র সঙ্গে থেকে কাজ শিখে নিক তাঁরা। যাঁরা প্রকৃতই কংগ্রেসকে ভালবাসে অথচ দলের কাজে লাগতে পারছেন না তাঁরা সংগঠনে ফিরুক আমরা চাই।” একইসঙ্গে তাঁরা এইআইসিসি’র বাংলার প্রতি মনোভাবেরও পরিবর্তন চাইছেন।
আব্দুস সাত্তারের কৃতিত্বকে সামনে রেখে এবার লোকসভায় ভোট টানতে চেয়েছিল কংগ্রেস। সেই সাত্তারের ছেলে আবু হেনা জেলা কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। অথচ ধারে ও ভারে এই প্রবীণ আইনজীবি, প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী এখনও জেলা কংগ্রেসের মানদন্ড। যিনি কখনও জাতীয় কংগ্রেসের বাইরে অন্য দলে ভেরার কথা ভাবেননি কখনও। কিন্তু তিনি দলীয় কাজে তেমনভাবে সক্রিয় নন। তাই তাঁকে দলে সম্মানজনক পদ দিয়ে জেলা সভাপতির দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়া হোক, বলছেন বৈঠকে উপস্থিত কেউ কেউ।
বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও মোসারফ হোসেন ওরফে মধুও বলেন, ” আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন পূর্ণ সময়ের জেলা সভাপতির পক্ষে।” যদিও লালগোলা বিধানসভায় কংগ্রেস ভাল ফল করেছে লোকসভা নির্বাচনে । তৃণমূলকে ১৪ হাজার ১৩৮ ভোটে হারিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছে আব্দুস সাত্তারের নাতি মুর্তজা হোসেন ওরফে বকুল। ওই লালগোলারই প্রাক্তন বিধায়ক আবু হেনা। এর আগেই তিনি সভাপতি পদে ইস্তফা দিতে চাইলেও অধীর তা গ্রহণ করেননি।
এদিনের বৈঠকেও গরহাজির ছিলেন জেলা সভাপতি। যদিও তিনি বলেন, “এই মিটিংয়ের কথা আমি জানতাম না। জানানো হলেও আমি যেতে পারতাম না।” মৌলালী যুবকেন্দ্রে সদ্য শেষ হওয়া প্রদেশ কংগ্রেসের বৈঠকে অবশ্য তিনি উপস্থিত ছিলেন। আবু হেনা বলেন “আমাকে ফোন করে প্রদেশের বৈঠকে হাজির থাকতে বলা হয়েছিল। এখানে অবশ্য কেউ ফোন করেননি। হয়ত অসুস্থ, যেতে পারব না ধরে নিয়ে জানায়নি।” বৈঠকের কথা অনেকেই জানতেন না বলে উপস্থিত হতে পারেননি তাঁরা, দাবি বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতার। ওই কারণেই এদিনের বৈঠকে হাজির ছিলেন না মহম্মদ আমিনুল ইসলামও। তিনি অবশ্য বলেন, “আমার এখানে (সাগরদিঘির ) এক অঞ্চল সভাপতির মেয়ের বিয়ে। সেখানেই আছি।”
মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের প্যাডে লেখা মুখপাত্র জয়ন্ত দাসের সাক্ষরিত বৈঠকের চিঠি দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠান হয়। সেই চিঠি এখন সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই অর্থে এই বৈঠক ডেকেছিলেন জয়ন্তই। চিঠি শুরুতেই লেখা ছিল “সাথী/ সভাপতি ও জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্মানীয় সদস্য/ সদস্যা গণ।” আলাদা করে তাই হয়ত কাউকে কিছু বলা হয়নি। সেই জন্যেই তাঁরা বলছেন বৈঠকে তাঁরা ডাক পাননি অনুমান বৈঠকে হাজির অনেকের। তবে বিষয়টি তাঁর জানা নেই দাবি করে জয়ন্ত অবশ্য বলেন, ” সভাপতিকে দল গুরুত্ব দেয় বলেই তিনি সভাপতি পদে আছেন।”