
.।। সুব্রত পাল, পেশায় স্কুল শিক্ষক, নেশায় ভ্রমণ পিপাসু। ছবি তোলায় পটু এই শিক্ষক সুযোগ পেলেই ঢুঁ মারেন পাহাড় থেকে জঙ্গলে। পাহাড়ি এলাকা রঙ্গারুন ঘুরে এসে সেই কাহিনী লিখলেন সংবাদ হাজারদুয়ারির পাতায় ।।
ছুটি পড়লেই মনটা কেমন উড়ু উড়ু হয়ে ওঠে। সেই স্কুলে পড়ার দিন থেকে শুরু করে স্কুলে পড়ানোর দিন পর্যন্ত এর কোনো ব্যতিক্রম এখনও আমার ঘটেনি। তাই উড়ু মনের ঠিকানা কখনও হয় সমুদ্র তো কখনও জঙ্গল কখনও পাহাড়। এবার পুজোর লম্বা ছুটির আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল কোনো নিরিবলি পাহাড়ের কোলে পাহাড়ের স্নিগ্ধতাকে উপভোগ করবো। সেই মতো হয়ে গিয়েছিল রঙ্গারুন আসা যওয়ার টিকিট কাটা।

কিন্তু অক্টোবরের শুরুতেই উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে যে দুর্যোগ নেমে এসেছিল তাতে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সাধের পাহাড়বাস সম্ভব হবে না হয়তো। তবে আমাদের একটা সান্ত্বনা ছিল আমাদের যাওয়া অক্টোবরের মাঝামাঝি, আর বর্ষা তখন বিদায় নিয়ে নেবে বঙ্গ থেকে। নির্দিষ্ট দিন যখন এল দেখলাম আমাদের ভাবনাটা একদম মিলে গিয়েছে। রাতের কামরূপ ধরে যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে পা রাখলাম মন তখনই নেচে উঠল স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনের ধবল রূপ দেখে। সকালই বলে দেয় দিন কেমন যাবে, এ প্রবাদ যে এভাবে মিলে যাবে কখনও ভাবিনি।

হোমস্টের পাঠানো ড্রাইভার আমাদের খুঁজে নিয়ে নতুন ভাবে সেজে ওঠা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের পার্কিং এ নিয়ে গেল। স্টেশন থেকে মোটামুটি সকাল আটটায় রওনা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। পথে লোহাপুলের কাছে হোটেল হাইওয়েতে সকালের খাবার খেয়ে নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল মংপুর রবীন্দ্রভবনের দিকে। কবি ও ঔপন্যাসিক মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী সিঙ্কোনা গবেষক ডঃ মনোমোহন সেনের এই সরকারি বাংলোয় ১৯৩৮ -১৯৪০ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকবার অবস্থান করেছিলেন। জীবনের অন্তিম পর্য়ায়ে এসে কবি তার বেশ কিছু সৃষ্টি করেছিলেন এই বাড়িতে বসেই। কবির স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিকে রবীন্দ্র মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এবার এগিয়ে চললাম আমাদের নির্ধারিত ও প্রতীক্ষিত রঙ্গারুনের উদ্দেশ্যে।

গাড়ি এগিয়ে চলল জোড়বাংলোর দিকে। মংপু থেকে ঘুম যাওয়ার রাস্তার এই জোড়বাংলো মোড় থেকে সোজা সিনচেল অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এক অদ্ভুত অনুভূতি আপনাকে গ্রাস করবে। এই রাস্তায় কোথাও কোথাও বন এতটাই ঘন যে দিনের বেলাতেও একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে স্পট লাইটের মতো সূর্যরশ্মি আপনাকে এই ভ্রম কাটাতে সাহায্য করবে। যদি ভাগ্য প্রসন্ন থাকে এই পথের ধারে দেখা মিলতে পারে বার্কিং ডিয়ারের। রাতের ট্রেনের জার্নি আর পথের ধকল শেষে যখন হোমস্টেতে পৌঁছালাম মন আর শরীর যেন পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। চা বাগানের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত এই হোমস্টের একটা দিক সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। হোমস্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা বাগানের সৌন্দর্যের সাথে ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘা মন ভরিয়ে দিল।

শীতের হালকা আমেজের সাথে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে হাতে এসে গেল গরম গরম চা। হোমস্টের আন্তরিক ও উষ্ণ আপ্যায়ন কখনও আমাদের মনে করতে দেয়নি আমরা বাড়ির বাইরে আছি। হোমস্টের মালিক দিদির হাতের রান্নার স্বাদ আর ব্যবহার দুটোই মনে রাখার মতো। সকলে স্নান দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়েছিলাম গ্রামটা ঘুরে দেখতে। নিস্তব্ধ পাহাড়ি গ্রামে সন্ধ্যা যেন হঠাৎ নামে। সন্ধ্যায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল একটা সারপ্রাইজ। সন্ধ্যায় চা আর পকোড়ার সাথে পরিবেশন করা হলো লাইভ কনসার্ট। পাহাড়ি মানুষগুলো নানা পেশায় যুক্ত থাকার পর এদের এই সঙ্গীতচর্চা মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো। সন্ধ্যা থেক রাতের খাবার পর্যন্ত পাহাড়িয়া সুরের জাদু মনকে আবিষ্ট করার পর যে সুখনিদ্রা হলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরদিন সকাল সকাল উঠে তৈরি হয়ে নিলাম রুংডুং নদী খাতে একটা ছোট্ট ট্রেকের জন্য। আমাদের হোম স্টে থেকে তিনচার কিলোমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত এই নদী। পাহাড় থেকে নেমে আসা এই নদী গিয়ে মিশেছে রঙ্গীত নদীর সাথে। আমাদের গাইড দাদা যথা সময়ে পৌঁছে গেলেও আমাদের বেরোতে একটু দেরিই হয়ে যায়। নটা নাগাদ শুরু করি আমাদের যাত্রা। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলার রাস্তা ধরে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করি সকলে। যাত্রার প্রথম প্রথম সবার উৎসাহ ছিল দেখার মতো। কিন্তু চওড়া রাস্তা আস্তে আস্তে যখন সংকীর্ণ হতে শুরু করলো, সঙ্গের কয়েকজন রণে ভঙ্গ দিল। গাইড দাদা আমি আর মেয়ে তিনজনে দাঁড়ালাম শেষ পর্যন্ত। একসময় আর চালচলের পথ ছিল না।

সদ্য বর্ষার শেষে আমরাই ছিলাম এই নদী ট্রেকের প্রথম ট্রেকার। ফলে রাস্তার উপর বর্ষার জলে পুষ্ট ও বেড়ে ওঠা বনজঙ্গল কেটে পথ তৈরি করে দিচ্ছিলেন আমাদের গাইড দাদা। স্যাঁতসেঁতে জোঁকাকীর্ণ পথ ধরে নামতে গিয়ে আমাদের বারকয়েক থামতে হয়েছে পায়ে আটকে যাওয়া জোঁকগুলোকে ছাড়ানোর জন্য। শেষ ধাপের প্রতিকূলতাকে টপকে যখন নদী খাতে পৌঁছালাম তখন আমার মেয়ের চোখে ছিল জয়ের আনন্দ। ওর এই প্রথম ট্রেকটা খুব ভালোভাবে উপভোগ করতে পেরেছে দেখে আমারও ভালো লাগছিল। গোমুখ, কেদার, অমরনাথ ট্রেকের তুলনায় এই ট্রেক সত্যিই নস্যি। কিন্তু যাদের এটাই প্রথম, তাদের কাছে এই ট্রেক একটা অন্যরকম অনুভূতি ও আনন্দ জাগায়। পাহাড়কে চিনতে হলে, পাহাড়কে ভালোবাসতে হলে পাহাড়ে হাঁটতেই হবে।

পাহড়ের প্রতিটা বাঁকে লুকিয়ে থাকে চমক আর রহস্য। এই রহস্যের উন্মোচন ঘটানো যায় গিঁট খোলার মতো একের পর এক বাঁক পেরোতে পেরোতে, চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে। পাহাড়ে নামা ওঠা দুটোই প্রায় সমান। এখানে আমরা আগে নেমেছি বলে এবার ওঠার পালা। নিশ্বাস প্রশ্বাসকে চলার তালের সাথে তাল মিলিয়ে নিলে ওঠার ক্লান্তি অনেক কমে যায়। সেইভাবে উঠে আমরা যখন হোমস্টে পৌঁছালাম তখন প্রায় দুটো বাজে। স্নান খাওয়া সেরে একটা ছোট ঘুম দিয়ে শরীরকে চাঙ্গা করেই নিতে পারেন আপনি। কারণ রাতে আবার অপেক্ষা করছে লাইভ কনসার্টের সাথে ঝলসানো মুরগী। দুটো দিন এই পাহাড়ি গ্রামে আপনার সময় কীভাবে কেটে যাবে বুঝতে পারবেন না। গতানুগতিকতায় ফিরে যাওয়ার একটা বেদনা অনুভূত হবে ঠিকই, কিন্তু যে পরিমাণ মানসিক প্রশান্তি আপনি পাবেন তা আপনার শারীরিক শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে।
Osadharon, opurbo sundor lekhoni o lekhok