
বিদ্যুৎ মৈত্রঃ মুর্শিদাবাদের জেলাশাসকের বদলিতে মাঠের মুখ ভার। বহরমপুর স্টেডিয়াম সংস্কার করা থেকে ইন্ডোর স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরি, সবেতেই এগিয়ে এসেছিলেন বেহালার ছেলেটা। সরকারি টাকায় সেই কোন বাম আমলে তৈরি হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকের সুইমিং পুল তা যে ফের তৈরি হতে পারে ভাবনাতেই আনেননি বহরমপুরবাসী। উদ্বোধন না হলেও তা প্রায় শেষ ধাপে।পুরনোকে ফেলে নতুন করে সরকারি সুইমিং পুল গড়ে তুলতে উদ্যোগ যাঁর, তিনি রাজর্ষি মিত্র। জেলাশাসক মুর্শিদাবাদ। সোমবার রাজ্যের আরও অনেকের সঙ্গে বদলির নির্দেশ এসেছে তাঁরও। আগামীকাল তিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেবেন হিডকোর।
মুর্শিদাবাদ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্যরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ছিল বহরমপুর স্টেডিয়াম। অথচ পদাধিকার বলে জেলাশাসক ওই সংস্থার সভাপতি, সদর মহকুমাশাসক কার্যনির্বাহী সহকারি সভাপতি। তবুও সেই মাঠের খেলাধুলা নিয়ে অতীতের আমলাদের আগ্রহ দেখা যায়নি বলেই দাবি তাঁদের। ব্যতিক্রম রাজর্ষি। নিজে উদ্যোগী হয়ে খেলোয়াড়দের জন্য ড্রেসিং রুম সংস্কার করেছেন, তিন নম্বর ফুটবল মাঠ তৈরি করেছেন, মূল মাঠে অতিরিক্ত দুটি বাতিস্তম্ভ বসিয়ে দিয়েছেন বলে জানান জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক বিশ্বজিৎ ভাদুড়ী।
তিনি বলেন ” আমাদের জেলা ক্রীড়া সংস্থার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন রাজর্ষি মিত্র। খেলাধুলার জন্য তিনি যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন।” ওই সংস্থার সহ সম্পাদক জগন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “খেলাধুলার ক্ষেত্রে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য রাজর্ষি বাবুর মতো সম্প্রতি কোনও জেলাশাসক এগিয়ে আসেননি। তাঁর রুটিন বদলি হলেও তাঁর অবদান মাঠ মনে রাখবে বহুদিন।”
জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সাবির বলেন, ” প্রায় দশ হাজার ছেলেমেয়ে প্রতিবছর বিভিন্ন খেলায় অংশ গ্রহণ করে। অথচ স্কুল স্পোর্টসের জন্য আমাদের কোনও নির্দিষ্ট মাঠ ছিল না। তা উপলব্ধি করে স্টেডিয়ামের উত্তর দক্ষিণ বরাবর আমাদের একটা মাঠ দিয়েছেন জেলাশাসক। এরফলে ওই পড়ুয়ারা উপকৃত হবে। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।” তিনি আরও বলেন, ” সংসদের কার্যালয়ে জলের ব্যবস্থাই হোক আর অর্থের প্রয়োজনই হোক তাঁকে জানালে তিনি কোনওদিন আমাদের নিরাশ করেননি।”
২০২২ সালের জুন মাসে মালদা থেকে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক হিসেবে বদলি হয়ে আসেন রাজর্ষি। তখনও টাটকা কোভিড আতঙ্ক। তিন বছর তিন মাসের কাছাকাছি মুর্শিদাবাদে তাঁর কার্যকাল। সেই সময়ে দেশের সেরা পর্যটন গ্রামের তকমা পেয়েছে কিরীটেশ্বরী গ্রাম। ওই গ্রামের মন্দির সংস্কার থেকে দর্শনার্থীদের জন্য অতিথি নিবাস তৈরি করে পর্যটকদের জন্য তা আকর্ষনীয় করে তুলতে আগ্রহী জেলাশাসক তার তদারকিও করতেন নিয়মিত। পর্যটক প্রিয় ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের ওয়াসিফ মঞ্জিলকে সংস্কার করেছেন পর্যটনশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে। যাঁরা সেসব জানেন তাঁদের দাবি, ” এখনও অনেক কিছু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাকি থেকে গেল।”
জেলা প্রশাসনের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায় তাঁর পরিশ্রমের কথা। জেলা নিয়ে তাঁর নানান পরিকল্পনার কথা। ‘ঠোঁটকাটা’ স্বভাবের কথা। তিনি জেলা থেকে বদলির আগে জেলার চিত্রশিল্পীদের বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ করেছেন স্বেচ্ছায়। উদ্বোধন করেছেন ডিস্ট্রিক্ট আর্ট গ্যালারির। তেমনি মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের সাক্ষী বহনকারি বহরমপুরের বারাকের সংস্কার করে বিভিন্ন রকমারি বিপণী খুলে একই সঙ্গে রোজগার ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সদ্য প্রাক্তন জেলাশাসক। যদিও ঐতিহ্যের সংস্কার করায় ক্ষুব্ধও হয়েছেন ইতিহাসপ্রেমিরা। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষোভ যুক্তিতে টেকেনি বলেই দাবি।
আলোর পাশেই থাকে আঁধার। তাঁর মেয়াদকালে বদলে যাওয়া সমাজে বেশ কয়েকটি অঘটনের সাক্ষীও থেকেছে মুর্শিদাবাদ। উত্তর থেকে দক্ষিণে বেশ কয়েকবার হিংসার ঘটনা ঘটেছে জেলায়। বেলডাঙা, নওদা হয়ে সমসেরগঞ্জের ধুলিয়ানে এখনও দগদগে হিংসার ক্ষত। কঠোর হাতে তা শেষপর্যন্ত সামলেছেন তিনি, কুড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসাও।
তিনি যখন জেলা ছাড়বেন, মুর্শিদাবাদবাসী তখন ঘাড় গুঁজে ভোটার তালিকায় নিজের নাম খুঁজে পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি’র জেলা নেতারা ওৎ পেতে থাকবেন কখন কোথায় ছাকনিতে আটকে পড়ে বাংলাদেশির নাম। সেই সময় যিনি পশ্চিমবঙ্গ আবাসন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংস্থা র ফাইল ওল্টাতে ব্যস্ত থাকবেন, তিনি এক উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময় তাঁর বাবা এদেশে চলে এসেছিলেন।
ইংরেজীর প্রাক্তন অধ্যাপক রাজর্ষি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন আমলার চাকরি। মালদার পর সংখ্যালঘু অধ্যূষিত জেলা মুর্শিদাবাদে জেলাশাসক পদে বসে তাঁকে সামলাতে হয়েছে রাজনীতির নেতাদের হম্বিতম্বি। সহজ অংকে তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব মেপে দাপটের সঙ্গে চালিয়েছেন রাজপাট। মুর্শিদাবাদের নেতারা তাঁকে বাগে আনতে না পেরে দুয়ো দিয়েছেন বারবার। তিনি কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে হেলায় পেরিয়েছেন বহু বিতর্কিত সাঁকো। মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদের কাজ কারবার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবু তিনি তা হাতের বাইরে বেরোতে দেননি। মুর্শিদাবাদের বিদায়ী এক বাঙালি জেলাশাসকের সেই সব কৃতিত্বই ছটের ছুটিতে দিনভর চর্চায় রাখল বহরমপুরবাসীকে।
যথার্থই সুন্দর লিখনী । গর্ব হয় এই বাঙালী জেলা শাসক মাননীয় শ্রী রাজষি মিত্রের জন্য।
অনেকদিন পর এই পিছিয়ে থাকা জেলা যথার্থ অর্থে একজন কাজের মানুষকে জেলা শাসক হিসেবে পেয়েছিল। বহরমপুরের ঐতিহ্য বহু ইতিহাসের সাক্ষী ব্যারকস্কোয়ারকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন। বইএর দোকান, কফি হাউস, আর্ট গ্যালারি, হস্তশিল্পর বিপনি – একটা উন্নত শহরে যা থাকার কথা কিন্তু ছিলোনা তা দিয়ে গেলেন। ভলো করতে চাওয়া যে কোন কিছুই অন্তরায় হয়না না তা প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন বিদায়ী জেলা শাসক রাজর্ষী মিত্র।