
সন্দীপন মজুমদার, বহরমপুরঃ শিরোনামে বেশ কাব্য করে বলা যেত প্যালেস্তাইনের আকাশ। কিন্তু প্যালেস্তাইন, বিশেষত গাজার আকাশ কী প্রবঞ্চক তা সবচেয়ে বেশি জেনেছে গাজার শিশুরা যখন সেখান থেকে ধারাস্নানের মত নেমে আসা আগুনে বোমায় ধ্বংস হয়েছে জনপদ। রক্ষা পায় নি নারী, শিশু, হাসপাতাল, বিদ্যায়তন, সাংবাদিক। প্রায় এক লক্ষ প্রাণ চলে গেছে ইজরায়েলের যুদ্ধোন্মাদ রাষ্ট্রনেতার প্ররোচনায়। কিন্তু’’ শিশুঘাতী নারীঘাতী কুৎসিত বীভৎসা” পরে ধিক্কার হানতে আমরা কিছুটা পিছিয়ে। এর জন্য দায়ী আমাদের সঠিক রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সচেতনতার অভাব।
সেই ঘাটতি মেটাতে উদ্যোগ নিল “পরের পৃষ্ঠা”, গত ১৫ ই নভেম্বর, শনিবার, বহরমপুর শহরে। বই কেন্দ্রিক সিরিয়াস আলোচনার ধারাবাহিক আয়োজনে ‘পরের পৃষ্ঠা’ ইতিমধ্যেই শহরে সাড়া জাগিয়েছে। সেই ধারাতেই সংযোজিত হল সর্বশেষ আলোচনা – বিশিষ্ট সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ীর কথনে হায়দার ঈদের ‘উপনিবেশ -মুক্ত প্যলেস্তানীয় চেতনা’ নামক বইটি । এই বইয়ের লেখক অধ্যাপক, তাত্ত্বিক, সংগঠক ,প্যালেস্তাইনের মুক্তিযোদ্ধা।
প্যালেস্তাইন প্রসঙ্গে সুদৃঢ় অবস্থানই আজকের পৃথিবীতে প্রগতিশীল আন্দোলনের কষ্টিপাথর।
বইটির বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপট বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে অর্কের কথনে মিশে যাচ্ছিল তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা। আন্তর্জাতিক প্যালেস্তাইন সংহতি আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী হিসেবে , সাংবাদিক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আন্দোলনের অভিঘাতকে যেভাবে দেখেছেন অর্ক তার এক প্রতিচ্ছবি আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠছিল সেই সান্ধ্য সমাবেশে। অর্ক জানিয়েছেন পৃথিবীব্যাপী উগ্র ইসলামবিদ্বেষী দক্ষিণপন্থার উত্থানের বিরুদ্ধে যে বিরাট প্রতিরোধী আন্দোলন হচ্ছে তার গুরুত্বের কথা । ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনার বিক্ষোভের কথা বিশদে আলোচিত হয়েছে। অর্ক জানাচ্ছেন এই সমস্ত আন্দোলনে একদম সামনের সারিতে থাকছে প্যালেস্তাইনের পতাকা ও তার দাবিগুলো।
পড়েছেন? না হলে ক্লিক করুনঃ বইয়ের পাঠক, পাঠকের বই- আশা জাগাল ‘পরের পৃষ্ঠা’
প্যালেস্তাইন প্রসঙ্গে সুদৃঢ় অবস্থানই আজকের পৃথিবীতে প্রগতিশীল আন্দোলনের কষ্টিপাথর। তবে সবার আগে প্যালেস্তাইন ইজরায়েল দ্বন্দ্বের পটভূমিকা জানা দরকার। ৭ ই অক্টোবর , ২০২৩ এ হামাসের ইজরায়েলের ওপর আক্রমণ থেকে এই সংঘাতের শুরু নয় । তার একটা বিস্তৃত পটভূমি আছে। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মই দেওয়া হয় প্যালেস্তাইনের এক বিস্তীর্ণ অংশের জমি দখল করে, সেখানকার অধিবাসীদের উৎখাত করে। তারপর দফায় দফায় সংঘাত, যুদ্ধ, ইজরায়েল কর্তৃক প্যালেস্তাইনে সেটলার বসিয়ে সেখানকার জনবিন্যাস বদলে দেওয়া, নিজভূমে ফিলিস্তিনীদের পরবাসী হয়ে থাকা, আরাফতের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালের দুই দফায় ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে অসলো চুক্তি এবং তার ব্যর্থতা — এসব ইতিহাস আমাদের জানালেন অর্ক যাতে ইজরায়েলের আগ্রাসী চরিত্র, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ এবং মিথ্যা আখ্যানগুলির স্বরূপ আরও বেশি করে উন্মোচিত হল।
বিজ্ঞানের বই নিয়ে শ্যামল চক্রবর্তীর আলোচনার আয়োজন করেছিল পরের পৃষ্ঠা
অসলো চুক্তির ভিত্তি “ টু স্টেট থিয়োরি’ যেখানে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন দুটি রাষ্ট্র পাশাপাশি থাকার প্রস্তাব— হায়দার ঈদ তার যে সমালোচনা রেখেছেন সেটাও ব্যাখ্যা করেন অর্ক। এডওয়ার্ড সাঈদও যে হায়দারের মতের শরিক তাও জানিয়ে দেন তিনি। হায়দারের প্রস্তাব অনুযায়ী ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন মিলিয়ে একটিই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হোক, যেখানে ইহুদী, মুসলিম, খ্রীস্টান সব নাগরিকই সমান অধিকার নিয়ে থাকবেন।
এই প্রসঙ্গেই অর্ক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে প্যালেস্তাইনের দাবি শুধু মুসলিম বা আরব আত্নপরিচয়ের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট নয়। প্যালেস্তাইনের আন্দোলনের সমর্থক অনেক আরব খ্রীস্টানও আছেন। অর্ক যেমন নিউইয়র্কের সদ্য নির্বাচিত মেয়র মামদানির জয়ের তাৎপর্য ব্যখ্যা করতে গিয়ে আমাদের জানান যে মামদানির জয় শুধু একজন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জয় নয়। মামদানির আসল পরিচয় তিনি আমেরিকায় জায়মান গণতান্ত্রিক সমাজবাদী মঞ্চের সক্রিয় সদস্য এবং প্যালেস্তাইন সংহতি আন্দোলনের কর্মী।
এদিন ‘বইয়ের ঠেক’-এ এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর চলে প্রশ্নোত্তরের পর্ব। শ্রোতারা ভারতে বামপন্থীদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা হয় অসলো চুক্তি প্রসঙ্গে হায়দার ঈদের দৃষ্টিকোণ এবং তাঁর বিকল্প প্রস্তাবের বাস্তব রূপায়ণের সম্ভাব্যতা নিয়েও। সব মিলিয়ে আলোচনাকক্ষ থেকে যে শ্রোতারা বেরিয়ে এলেন তাঁরা এই প্রসঙ্গে অনেকটাই সচেতনতা অর্জন করলেন অর্ক ভাদুড়ী এবং আয়োজকের সৌজন্যে।
আমাদের পাবেনঃ
খুব ভালো প্রতিবেদন। প্রতিবেদক সন্দীপন মজুমদার ও সংবাদ হাজারদুয়ারী কে ধন্যবাদ জানাই। তারা ধারাবাহিক ভাবে পরের পৃষ্ঠা র বই আলোচনার উপর আলোকপাত করে চলেছেন।
দুর্দান্ত নিটোল প্রতিবেদন। যেনো মনে হলে আলোচকের আলোচনা সেদিন শুনেছিলাম ও দেখেছিলাম। আজ পড়লাম। অনবদ্য