হারিয়ে যাওয়া গৌড়ীয় নৃত্য পরিবেশিত হল উজানের নাট্যোৎসবে

Social Share
মঞ্চের নৃত্য পরিবেশন করছেন মহুয়া মুখোপাধ্যায় (বাম দিকে), কর্মশালায় শৈবাল রায় (ডানদিকে)

আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বহরমপুরঃ তামিলনাড়ুতে ভরতনাট্যম, অন্ধ্রপ্রদেশে কুচিপুডি এবং ওড়িশায় ওড়িশি নৃত্যের মতো বাংলাতেও আছে ধ্রুপদী নৃত্য। সেই নাচের নাম গৌড়ীয় নৃত্য। যা অনেকরই অজানা। সম্প্রতি বহরমপুর উজান নাট্যোৎসব ২০২৫ এর উদ্বোধনী সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হল বাংলার সেই হারিয়ে যাওয়া ধ্রুপদী নৃত্য। গৌড়ীয় নৃত্য আঙ্গিকে তিনটি প্রযোজনা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মহুয়া মুখোপাধ্যায়। যিনি তাঁর নিরলস ৪০ বছরের গবেষণায় এই নাচকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন।

অধ্যাপক শৈবাল রায় বলেন, নাট্যশাস্ত্রে পরোক্ষে উল্লেখ রয়েছে এই গৌড়ীয় নৃত্যের। কিন্তু উত্তরকালে কথাকলি বা ভারতনাট্যম যেভাবে উঠে এসেছে, ঠিক তার বিপরীতে গৌড়ীয় নৃত্য চলে গিয়েছে স্মৃতির অন্তরালে। ড. মহুয়া মুখোপাধ্যায় সেই ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ করেছেন, প্রাচীন কিছু গ্রন্থের উল্লেখ, মন্দিরের মৃৎফলক এবং লোক ঐতিহ্যের থেকে সূত্র নিষ্কাশন করে। তিনি আরও বলেন, ” এখানে নাচ তো আছেই, কিন্তু নাচের মধ্যে মিশে আছে একধরণের গল্প বলা, একটা ভারি সুন্দর হস্তভেদ নির্ভর শৈলীতে।” এদিনের অনুষ্ঠানে মহুয়া ও তাঁর সহযোগী নৃত্যাভিনয় করলেন, ‘পুতনা মোক্ষ’, ‘গীতগোবিন্দ’ এবং ‘কৃষ্ণ রাম কথা’।”

এই নৃত্য ধারায় আছে ছৌ। অভিজ্ঞদের মতে, ” এই নৃত্যধারা নাটক, কবিতা, রঙ, গল্পের মিশ্রণ – যা ভাস্কর্য, সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ, গুরু-শিষ্য পরম্পরা নৃত্য ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে তৈরি।” এই গৌড়ীয় শৈলীর আর একটি বিশেষ দিক এর সঙ্গীত। সে সব গানের কথা যেমন একটা গল্প সূত্র ধরে রাখে তেমন তার সুরে এক ভূবনমোহিনী আবেশ। পণ্ডিত অমিতাভ মুখোপাধ্যায় সে নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করে সেই ফেলে আসা গানের মেলাকেও পুনঃনির্মাণ করেছেন বলে দাবি করেন শৈবাল।

মঞ্চে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক এবং চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন ডিন সত্তর ছুঁই ছুঁই শিল্পী মহুয়া মুখোপাধ্যায় এইসব পুনরুদ্ধারের কাজে উল্লেখ করেন মুর্শিদাবাদের প্রয়াত দুই শিল্পীর কথা। জঙ্গীপুরের, কীর্তনাচার্য গুরু নরোত্তম সান্যাল এবং পাঁচথুপীর মৃদঙ্গাচার্য গুরু ব্রজরাখাল দাস। তিনি বলেন, ” ওঁরা নিজেরাও হয়তো সচেতন ছিলেন না কি মহান উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন।

চলতি মাসের ১৪ তারিখ সকাল থেকে মহুয়া মুখোপাধ্যায়, শৈবাল রায়ের সঙ্গে, উজানের হয়ে এক নাট্যকর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হয় ‘বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাস : অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতক’ শীর্ষক এক স্মারক পত্রের প্রচ্ছদ । ওয়ার্কশপ এবং স্মারকের প্রচ্ছদ উন্মোচন করেন আর এক অধ্যাপক মধু মিত্র। অধ্যাপক মিত্র বহরমপুর গার্লস কলেজের পক্ষথেকে গৌড়ীয় নৃত্য নিয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।

তবে এই শাস্ত্রীয় নৃত্য এখনও ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যের মর্যাদা না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেন শৈবাল। তিনি বলেন, ” আসলে ইতিহাস এই ধারাটা ভুলে গিয়েছিল। মহুয়া দি’র লড়াইটা আদতে এই ডান্স ফর্মের মর্যাদা আনার। আর এ বিষয়ে জনসচেতনতা জরুরী। বিশ্ববিদ্যালগুলিকেও এ বিষয়ে সচেতন পাঠ দানের পরিসর নির্মাণ করতে হবে। যতটা দরকার এখনো তা সম্ভব হয় নি। উজান কে ধন্যবাদ যে তাঁরা সাহস করে এরকম একটা বিষয়কে একেবারে মঞ্চে তুলে আনতে সাহায্য করলেন। ”

বহরমপুর উজানের পক্ষ থেকে সম্পাদক নির্ঝর সান্যাল জানান, “অধ্যাপক চরণ টুডু, অধ্যাপিকা পম্পি সিদ্ধান্ত এবং অধ্যাপক আল মামুন হাসান, আমাদের জন্য থিয়েটারের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন। আমরা চাই নাট্য সংস্কৃতির একটা বহুমুখী দিক ফুটে উঠুক। “

তবে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন দেখতে তেমন দর্শকের উপস্থিতি ছিল না। এমনকি দেবশঙ্কর হালদারের মতো ব্যক্তিত্বের প্রযোজনাতেও হল না ভরায় উজানের সভাপতি পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়ের গলায় ঝরে পড়ল একরাশ আক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights