এক ট্রেন, দুই-মালি, CAG দেখিয়ে হাসেন অন্তর্যামী

Social Share
কলকাতা-সাইরাং এক্সপ্রেস যখন বহরমপুরে পৌঁছায়

বিদ্যুৎ মৈত্রঃ ভারতের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে পূবের বাংলা জুড়ে দিল কলকাতা-সাইরাং এক্সপ্রেস। পুজোর মরশুমে সেই খুশিতে আটখানা একাংশ মুর্শিদাবাদবাসী। বহরমপুর কোর্ট স্টেশনের চারপাশে বাজছে কাঁসর, বাজছে চরাম চরাম ঢাক। বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ওরফে কাঞ্চন মৈত্রের অনুগামীদের মুখে শ্লোগান “মহান দেশের মহান নেতা নরেন্দ্র মোদি জিন্দাবাদ।”

প্রায় একই ছবি মুর্শিদাবাদ স্টেশনে। সেখানকার বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষের নেতৃত্বে নতুন ট্রেনকে স্বাগত জানাতে হাজির তাঁর অনুগামীরা। সাধারণ মানুষ যাদের নিত্য যাতায়াত লালগোলা-শিয়ালদহ প্যাসেঞ্জার ট্রেনে, সেই ট্রেন যাঁদের লাইফ লাইন, তাঁদের মুখে মিষ্টি গুঁজে দিয়ে ‘মোদিজি’র জয়ধ্বনি দিতে দিতে প্ল্যাটফর্ম থেকে প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিধায়ক ও তাঁর অনুগামীরা।

যা দেখে মনে হবে পুজোর আগে অকাল পুজোয় মেতেছেন জেলাবাসী। যা দেখে মনে হচ্ছে , এই অভাগা রাজ্যে একটি এক্সপ্রেস ট্রেন চালিয়ে মোদি এক্কেবারে কাজের কাজ করে ফেলেছেন। মানুষের দুঃখ, দুর্দশা সব একমাত্র চাহিদা এই ট্রেনের আমদানিতে মিটে গিয়েছে। আর তা করেছেন মহান নেতা। কেউ বলছেন বিশ্ব নেতা নরেন্দ্র মোদি। সঙ্গে ভাগাভাগি করে অমিত শাহের নামটাও কেউ জুড়ে দিচ্ছেন শ্লোগানে। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে অশ্বিনী বৈষ্ণবের নামটাও তারস্বরে উচ্চারণ করছেন। পাছে তিনি চটে না যান। আর নেতাদের শারীরিকভঙ্গি বলে দিচ্ছিল ছাব্বিশে রাজ্যের মসনদ নড়ে তৃণমূল পড়ে যাবে। সেখানে টুক করে উঠে বসবেন শুভেন্দু অধিকারী ও তার দলবল। তখন “দেখবি আমার মান রে।”

গলায় নরেন্দ্র মোদির ছবি লাগিয়ে ট্রেনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বহরমপুরের বিধায়ক

আর ঠিক এই জায়গায় তৃণমূল ঘরে বসে থাকতে পারেনি।বাংলার জমির ওপর স্টেশন, বাংলার জমির ওপর দিয়ে চলে যাবে মিজোরাম থেকে আসা এক্সপ্রেস ট্রেন! তা হয় না কি? সেই ট্রেনের যাত্রী তাঁদের কেউ কেউ ঘাসফুলকে ভোট দেন (?) সেখানে তাদের কমতি কিসে। যেমনি সে কথা এল মনে, অমনি নেতারা চললেন স্টেশনে। মুর্শিদাবাদ স্টেশনে ঢুকেছে ট্রেন। জোড়া ফুল আর পদ্ম ফুলের পতাকা এবলে আমায় দেখ ও বলে আমায়। সটান চালকের আসনে পৌঁছে “অসুস্থ” সাংসদ আবু তাহের খান মুর্শিদাবাদ পুরসভার‍ চেয়ারম্যানকে নিয়ে সবুজ পতাকা নেড়ে গৌরীর বাড়া ভাতে ছাই ফেলে কৃতিত্ব কেড়ে নিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন ঘাসফুল কিসিসে কম নেহি। এই ট্রেন আমাদের জন্যই চলেছে। জনসাধারণকে সুবিধা পাইয়ে দিলাম আমরাই। কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী যতই বিজেপি’র হোক না কেন আমাদের এনও সি নিয়েই তো কেটেছে নশিপুর জট। দু-হাজার ছাব্বিশ হা করে তাকিয়ে আছে শুধু আমাদেরই সমর্থনে।

সাংসদ আবু তাহের খান মুর্শিদাবাদ পুরসভার‍ চেয়ারম্যানকে নিয়ে সবুজ পতাকা নাড়ছেন

আর এইসব দেখে সাধারণ মানুষ, দিন আনি দিন খাই মানুষ হেসে ফেলে জানতে চাইছেন “এই ট্রেনে আমরা উঠতে পারব কি? আমাদের লাভ হবে কি?” প্রতিদিন চাপাচাপি করে, ঝগড়া ঝামেলা করে ক্লান্ত কোমড়টাকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য দেড় ফুটের একটি আসনে চেপ্টে লেগে থেকে হাপিত্যে্স অপেক্ষা করতে হয় কখন সেই যাত্রী নামবে বলে। সে সবের অবসান হবে কি? তাঁরা জানতে চান টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেও আসন না পাওয়ার মতো যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলবে কি? তাঁরা জানতে চান জনপ্রতিনিধির ছাড়পত্র ছাড়া কি মিলবে না এক্সপ্রেসের আসন ?

নতুন এই ট্রেনে রোজ মিজোরাম যাবে না কেউ। এখানেও নেই আধুনিক সুবিধাযুক্ত কোনও বগি। বরং প্রয়োজন লালগোলা শিয়ালদহ রুটে আরও কয়েক জোড়া ট্রেন। প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা যুক্ত ভাগরীরথীর থেকে আরও উন্নত এক্সপ্রেস ট্রেনও। একটি নতুন ট্রেন চালু হলে নিশ্চিত কিছু সুযোগ সুবিধা মেলে। কিন্তু সেই ট্রেনের সামনে পতাকা নেড়ে বাহবা কুড়নোর বদলে জনপ্রতিনিধিরা যদি দরদাম করে রেলমন্ত্রীকে দিয়ে আরও কয়েকটি ট্রেন উপযুক্ত পরিষেবা দিয়ে চালানোর ব্যবস্থা করেন তাহলে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য পারস্পরিক খিস্তি খেউরের প্রয়োজন হতো না। রেলেরও দু-পয়সা লাভ হতো। বেসরকারির দিকে ঝুঁকতে হতো না। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো নেতা রবিবার স্টেশনে কেউ ছিলেন না। কিছুটা তফাত যেমন থাকে মানুষে মানুষে। তেমনি কাঞ্চনের গলায় ছিল ভিন্ন সুর। বললেন “লালগোলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ট্রেনে শৌচাগার নেই। এইসব ট্রেন বাতিল করার অনুরোধ করেছি ডিআরএমকে।”

আসলে নির্বাচনের আগে এই ধরনের দূরপাল্লার ট্রেন যা সময়ের দাবি তা চালিয়ে বিজেপি সরকার যে কৃতিত্ব নিতে চাইছে তা স্রেফ ‘জুমলা’ ছাড়া অন্য কিছু যে নয় তা বুঝছেন অন্তর্যামী রেলের খাতা কলম। ক্যাগের (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (CAG)) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ এই তিন বছরে রেলের ক্ষতি হয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা। পরিষেবা জুটবে কোথা থেকে? কী কারণে এই ক্ষতি। আর্থিক অনিয়ম আর দুর্নীতি এর একটা বড় কারণ। গত মাসে বর্তমান পত্রিকা সেই রিপোর্ট তুলে জানিয়েছিল “শহর ও শহরতলির লোকাল ট্রেনে ৭ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। টু টিয়ার এসি ক্লাসে ৫৬০ কোটি টাকা। স্লিপার শ্রেণিতে ১৭ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সেকেন্ড ক্লাসে ১৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। শুধু এই ক্ষেত্রগুলিতেই অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে রেল।”

( মতামত ব্যক্তিগত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights