বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ বিচারহীন ৫৪ দিন। এভাবেই ক্যালেন্ডার থেকে একটা একটা করে দিন কেটে দিচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। চলতি বছর ৯ অগস্ট আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণ করা হয়েছে হাসপাতাল চৌহদ্দিতেই। তার ন্যায় বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়েছে নাগরিক সমাজ। মহানগর থেকে জেলার সদর শহর সর্বত্র প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। তারই অনুসারি পয়লা অক্টোবর সন্ধ্যা। ওই দিন বহরমপুর টেক্সটাইল কলেজ মোড়ে ‘রাত দখলের মেয়েরা’ প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন। গান, কবিতা, নাটকের মাধ্যমে ফের সেখানে বিচারের দাবি তুলেছেন তাঁরা।

ঠিক ওই সময়েই বহরমপুর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে হরিহরপাড়ায় বসেছিল আবাদ উৎসব। আনন্দ আশ্রমের আড়ালে মূলত হরিহরপাড়া থানার আয়োজনে লোকসঙ্গীতের সুর শুনতে সেখানে হাজির ছিলেন গ্রামবাসীরা। রাতভর সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই উদযাপন হয়েছে মহালয়ার। আবার বহরমপুর লাগোয়া মুর্শিদাবাদ পুরসভাতে মহালয়ার ভোর দখল হয়েছে অভয়া মঞ্চের ডাকে। একইভাবে কলকাতা সহ রাজ্যের একাধিক জায়গায় প্রতিবাদ জারি থেকেছে অক্টোবরের পয়লায়। কিন্তু তার বেশিরভাগটাই শহরাঞ্চলে হয়েছে।

আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। আরজিকর হাসপাতাল কান্ডের জেরে উদ্ভুত আন্দোলন কি তবে গ্রাম ছুঁতে পারেনি ? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যবাসীকে উৎসবে ফেরার ডাক দিয়েছিলেন। মহালয়া সেই অর্থে উৎসবের শুরু। অথচ অন্যবারের তুলনায় ২০২৪ এর উৎসব আলাদা। শোকের আবহে উৎসবে মাতোয়ারা হতে চাননি একাংশ মানুষজন। তাঁদের অনেকেই পুজোর ক’টা দিন বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন। সেই ডাক কি গাঁয়ের মানুষ শুনতে পাননি? তবে কী মানুষজন ধীর লয়ে উৎসবেই ফিরছেন?

পয়লা অক্টোবর হরিহরপাড়ায় গিয়ে সেই প্রশ্নই মনে এসেছে। সেখানকার একটি বেসরকারি বিএড কলেজে আয়োজিত বাউল সঙ্গীতের আসরে ছিল উৎসবের মেজাজ। সেই মঞ্চ থেকে মুর্শিদাবাদের সাংসদ আবু তাহের খানও স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে মহালয়ার শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি উৎসবে ফেরার ডাকই দিয়েছেন। ওই মঞ্চেই হাজির ছিলেন হরিহরপাড়ার প্রাক্তন বিধায়ক ইনসার আলি বিশ্বাস। তিনি অবশ্য বলেন, “এই বাউল উৎসবের সঙ্গে ওই প্রতিবাদ আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। দুটো ভিন্ন বিষয়।” তাঁর দাবি, ওই এলাকাতেও আরজিকরের জাস্টিস চেয়ে সজাগ রয়েছেন গ্রামবাসী।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টেক্সটাইল কলেজ মোড়ে যে জমায়েত হয়েছিল সেখানে মানুষের ভিড় কম হয়েছে আগের বেশ কয়েকটি জমায়েতের তুলনায়। উপাচার সবই ছিল।মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে প্রতিবাদও ছিল। গান ছিল। শ্লোগান ছিল। কিন্তু ১৪ অগস্টের সঙ্গে তার তুলনা টানলে একশো ভাগের এক ভাগও জমায়েত হয়নি অক্টোবরের পয়লায়। শুধু তাই নয়, ওই জমায়েতে উপস্থিত মানুষজনের একাংশের দাবি, প্রতিবাদ যান্ত্রিকতায় পরিণত হচ্ছে। এমনকি শ্লোগানেও সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। ব্রীহি ওই দিন যে নাটক মঞ্চস্থ করেছে সেই ‘যারা উজানে’ও এই পর্বে নির্মিত অন্যদলগুলির নাটকগুলির মতোই গতানুগতিক, কি সংলাপে কি অভিনয়ে। দাবি একাংশ উপস্থিত দর্শকদের। যদিও তাঁরা একে প্রতিবাদের চিহ্ন হিসেবেই দেখতে চাইছেন।

অথচ বহরমপুরে একটি ঝড় সংবাদ সাহিত্য পত্রিকা আয়োজিত রবিবারের সভায় এসে চিকিৎসক ও জুনিয়র চিকিৎসক আন্দোলনের অন্যতম মুখ ভূমিপুত্র গৌরাঙ্গ ভৌমিক বলেছিলেন, ” আন্দোলনের তীব্রতা নবান্ন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। আমরা বিচার ছিনিয়ে আনবই। আপনারা যাঁরা এই আন্দোলনকে গণ আন্দোলনের রূপ দিয়েছেন তাঁরাই আমাদের উপদেষ্টা। আপনাদের কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমরা মহালয়ার আগে মহালয়া সংগঠিত করেছি।”
শিক্ষক দেবজ্যোতি বিশ্বাস একেবারে প্রথম দিন থেকে বহরমপুরে সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলছেন, ” প্রথমত প্রত্যেক ব্যক্তির একটি নিজস্বতা রয়েছে। সেখানে সে তারমতো করে বিষয়টিকে ভাবছেন। কিন্তু সকলেই প্রতিবাদে আছেন। দ্বিতীয়ত, ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে যে প্রতিবাদ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল সময় অনেকটা সেই শোক থিতিয়েছে। তাই বলে কেউ কী আর বোন বা দিদির মৃত্যুকে ভুলতে পারে? তা পারে না। এক্ষেত্রেও তাই।” তবে গ্রামাঞ্চলে যে এই আন্দোলনের তীব্রতা কম তা মানছেন এই শিক্ষকও। তিনি বলছেন, ” প্রতিবাদ শহরাঞ্চলেও হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলেও হচ্ছে। কোথাও কম কোথাও বেশি এই যা তফাত।”
আরও পড়ুনঃ স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে মহালয়ার রূপকথা শৈশবের দিন