
বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ সমবায় সপ্তাহ পেরিয়ে গেল গত কাল বৃহস্পতিবার। মুর্শিদাবাদ জেলাতেও নিয়মমাফিক পালিত হয়েছে সমবায় সপ্তাহ। সমবায়কে বাঁচিয়ে গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সমিতিগুলিকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আশার আলো দেখিয়েছে সাধারণ মানুষের সমবায় ব্যঙ্কগুলিতে জমা দেওয়া টাকার পরিমাণ। তবুও সমবায়ের সঙ্গে জড়িত জেলার শীর্ষ কর্তাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেনা।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ” কোঅপারেটিভ-প্রণালীই আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায়।” তিনি তাঁর সমবায় প্রবন্ধে আরও লিখেছিলেন, ” সমবায়-প্রণালীতে চাতুরী কিম্বা বিশেষ একটা সুযোগে পরস্পর পরস্পরকে জিতিয়া বড়ো হইতে চাহিবে না। মিলিয়া বড়ো হইবে।”
কিন্তু মুর্শিদাবাদে সমবায়গুলির ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সমবায় তৈরি করতে উদগ্রীব মানুষজন ঠিকই। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে, সদস্য সংখ্যা দেখিয়ে সমবায় তৈরিও হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যেই ঋণ দেওয়া শুরু হয় তখন আর সেই ঋণের টাকা ফেরত আসে না। একসময় দেনার দায়ে অচল হয়ে পরে সেই সব সমবায়। শোনা যায় ওই সব সমবায়ের দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানের টেবিলের নিচেই তৈরি হয় দুর্নীতির বাসা।
অথচ দুর্নীতির ছায়া না পড়লে এই সমবায়ই বাঁচাতে পারতো গ্রামের অর্থনীতিকে। চাষের জমি, মাছের পুকুর আরও সমৃদ্ধ হতে পারতো। নতুন প্রজন্ম অর্থনীতির দিশারি হয়ে উঠতে পারতো। নেই আর শুধু নেই, শুনতে হতো না পরিচালকদেরও। সূত্রের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে সমবায়গুলিতে নির্বাচন না হওয়ায় জেলায় ঋণ খেলাপি সমবায়ের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে দুর্নীতিও।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, যাদের অধিকাংশের মাথায় হয় ছাতা নেই কিংবা শীর্ষাসনে যিনি বসে আছেন সেই চেয়ারম্যান শাসকদলের হয় ঘনিষ্ঠ না হয় নেতা। কোথাও কোনও অসত আধিকারিক সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সব জেনেও চেয়ার ঠেলে সমবায়ের দায়িত্বে থাকা জেলা আধিকারিক ও কর্মীদের গয়ংগচ্ছ মানসিকতা ও অসততায় ভর করে লাগামছাড়া হয়েছে সমবায়ের দুর্নীতি। পদে পদে শাসকের বাধাতেও ঋণ খেলাপি ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি বলেও পাল্টা দাবি উঠেছে কর্মীদের পক্ষ থেকেও। তবে তদন্তের পাশাপাশি প্রমাণিত দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন সাংসদ আবু তাহের খান।
জেলা সমবায় আধিকারিকের দফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় তেরোশো কোটি টাকা জমা পড়েছে জেলার সমবায়গুলিতে। এই বছরই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই জমা হওয়া তহবিলের পরিমাণ ছিল প্রায় বারোশো কোটি টাকা। একমাসে সাধারণ মানুষের অতিরিক্ত একশো কোটি টাকা জমা পড়েছে বলে জানান মুর্শিদাবাদের সমবায়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মানব বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কয়েকটি সমবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও পালন করছে বলে দাবি তাঁর। কিন্তু একইসঙ্গে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। তারমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী পড়ে আছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। সেই টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে শীতেও ঘাম ছুটছে কর্তাদের।
সমবায় দফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় সমবায় আইন প্রয়োগ করে এই রকম ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে সমবায় সমিতিগুলির পক্ষ থেকে ১৫০টি মামলা দায়ের হয়েছে। বেঙ্গল পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে সমবায় সমিতির পক্ষ থেকে ১১টি মামলা দায়ের হয়েছে। জেলার একাধিক থানাতেও ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে।
মুর্শিদাবাদে সমবায় সমিতি আছে ১ হাজার ৭৯৬টি। তারমধ্যে এক হাজার ৯৯টি সমবায় সচল আছে। ডিআরসিএস বলেন, “এই সংখ্যাটি আগামী দিনে আরও বাড়বে।” তিনি আরও একটি আশার কথাও শুনিয়েছেন। তাঁর দাবি, ” গত ১৫-১৬ মাসে রাজ্যের মধ্যে সবথেকে বেশি মুর্শিদাবাদের প্রায় বিশটি সমবায়কে সক্রিয় করা হয়েছে।” তারজন্য জেলার ২৬টি ব্লকেই তৈরি হয়েছে বিশেষ কমিটি। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রশাসন কঠোর হাতে সমিতিগুলি পরিচালনা করলে সমবায়ের স্বাস্থ্য ফিরবে। সেই কাজটাই শুরু হয়েছে মুর্শিদাবাদে।