
তুহিন শুভ্রঃ সভ্যতার আদিকাল থেকে শান্তিকামী মানুষ এবং শিল্পীরা একযোগে যুদ্ধহীন পৃথিবীর কল্পনা করে এসেছেন। কৃষক ফসল ফলিয়েছেন, মাঝি-মাল্লারা গান বেঁধেছেন। প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ রচনা করেছেন নিসর্গ। আবার কেউ কেউ শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের প্রতি নতজানু হয়ে তাদের জীবনচিত্র ধরতে চেয়েছেন রঙে, রেখায়। কিন্তু কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়নি। ফসল ফলানো, পশুপালন, আশ্রয় নির্মাণ, এমনকি আগামীর জন্য খাদ্য মজুতের মতো জীবনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলি সুনিশ্চিত করা গেলে মানুষ মনের খোরাকের জন্য শিল্পের কাছে গেছে, তবুও যুদ্ধের কাছে যায়নি।
তাহলে সভ্যতার অগ্রগতিতে যুদ্ধকে কীভাবে অপরিহার্য বলা যায়? অথচ সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই বিচ্ছিন্ন হয়েছে বৃহৎ ভূখন্ড, জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন দেশ, যুদ্ধের মধ্য দিয়েই। আধুনিক সভ্যতায় পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত নেই, যেখানে শতাব্দী কোনো যুদ্ধ দেখেনি। আজকের তারিখেও পৃথিবীর একাধিক স্থানে ঘটে চলেছে এই অভিশপ্ত খেলা। কবুতরের বাজির মতো এইমুহূর্তে গাজার আকাশ কালো করে দিয়ে গেলো একঝাঁক ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান।

এরপরেও মানুষ যুদ্ধ চায় না। কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে একাকী বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সাঁজোয়া গাড়ির সামনে অথবা মুক্ত বেয়নেটের বিপরীতে। জন্মসূত্রে ইরানি শামসিয়া হাসানী এমনই একজন যুদ্ধের বিপরীতে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রশিল্পী। তাঁর আঁকা বেশকিছু ছবিতে সেজে উঠেছে ব্রীহি’র এবারের নাট্যোৎসব প্রাঙ্গন। এই প্রদর্শনী আয়োজনের নেপথ্যে আছেন মুক্তচিন্তার প্রচারক, জেলার সুপরিচিত চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। মূলত এমনই উন্মুক্ত প্রাঙ্গন কিংবা রাস্তার ধারের দেওয়াল শামসিয়া হাসানীর শিল্পচর্চার প্রিয় ক্ষেত্র। তাই তিনি যথার্থই ‘রাস্তার শিল্পী।’

হাসানীর পিতা মাতা উদ্বাস্তু আফগান। তিনি কাবুলের মতো তালিবানি ডেরায় ‘রাস্তার শিল্পকে’ জনপ্রিয় করেছেন। এমনিতেই চিত্রশিল্প, সংগীত, নৃত্যের মতো কোনো শিল্পচর্চাকেই ইসলাম ভালো চোখে দেখে না। প্রতিমুহূর্তে শিল্পীর উপর নেমে আসে প্রাণনাশী ধর্মীয় ফতোয়া। মধ্যপ্রাচ্যের মতো কট্টর ইসলামিক মৌলবাদী দেশগুলির বুকে দাঁড়িয়ে একজন নারী চিত্রশিল্পীর নিরন্তর ছবি এঁকে যাওয়া— এ যেন ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক ভিতকেই সরাসরি নাড়িয়ে দেওয়ার সামিল। ফলস্বরূপ তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁর প্রায় সমস্ত ছবিরই মুখ্য চরিত্র একজন বোরখা পরা নারী, যাকে শিল্পী বাস্তবের চাইতেও বড়ো করে দেখাতে চান। তাই তো তিনি সদর্পে ঘোষণা করতে পারেন— ‘আমি আফগানিস্তানকে তার শিল্পের জন্য বিখ্যাত করতে চাই, যুদ্ধের জন্য নয়।’

আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আকাশে পাকশাট খাওয়া যুদ্ধবিমানের দিকে একটি মেয়ে ছুঁড়ে মারতে চাইছে কাগজের তৈরি এরোপ্লেইন।
তাঁর ছবিতে কখনো দেখা যায় একটি মেয়ে তার বহু যত্নে লালন করা স্বপ্ন অথবা প্রতীকী ফুলসহ টব মাটিতে ফেলে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। পিছনে নিরবচ্ছিন্ন ভীতির মতো দাঁড়িয়ে আছে— হাতে বন্দুক, জঙ্গিরূপী ধর্মীয় ছায়া-ফতোয়া। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আকাশে পাকশাট খাওয়া যুদ্ধবিমানের দিকে একটি মেয়ে ছুঁড়ে মারতে চাইছে কাগজের তৈরি এরোপ্লেইন। ওই মুহূর্তে কাগজের এরোপ্লেইন আর কাগজের থাকছে না, হয়ে উঠছে সমগ্র পৃথিবীর একটি সম্মিলিত আওয়াজ— সেই আওয়াজ যেন বলতে চাইছে, বন্ধ করো তোমাদের এইসব বিধ্বংসী আস্ফালন, সৃষ্টির ধ্বজা ধরো। তবে শুনলে তো? যুদ্ধবাজ একনায়ক, কট্টর মৌলবাদ, ধর্মীয় জঙ্গিপনা— এরা কখনো ফুল-পাতা-ঘাস, রঙ-তুলি-সুর, শিশু-প্রাণের জন্মকথা শুনতে পায় না, এরা জন্ম-বধির। ধ্বংসেই এদের যাবতীয় সুখ!

লেখক তুহিন শুভ্র’র প্রাথমিক পরিচয় একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। থিয়েটার থেকে চিত্রশিল্প, কবিতা থেকে উপন্যাস সবেতেই তাঁর কৌতুহল। এমনকি স্রোতের বিপরীতে চলাতেও উৎসাহ। তাঁর সৃজনশীলতার ছাপ কী প্রবন্ধে, কী সঙ্গীতে, উপভোগ্য রসিকজনের।