
বিদ্যুৎ মৈত্র: বিশ্বের দীর্ঘতম সাঁতার প্রতিযোগিতা যেখানে শেষ হয় সেই ভাগীরথী পারেই গান্ধী কলোনি। কলোনি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে রবিবার সেখানে কৃতিদের নিয়ে ভেসে গিয়েছিল বহরমপুর। বছর খানেক আগে ওই পথ দিয়েই বন্ধুদের কাঁধে করে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে এসেছিল তপু। তপু সরকার। বয়স কুড়ি। কৃষ্ণনাথ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ২০২৪ এ আহিরণ থেকে কেএন কলেজ ঘাট পর্যন্ত ৮১ কিলোমিটার সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রত্যয় ভট্টাচার্য্যের পরেই ছিল তপু। দ্বিতীয় হয়ে আঁধার ঘরে আলো জ্বেলেছিল সে। মুহূর্তে ভাইরাল হয়েছিল সেই সব ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি। তারপরের পর্ব জুড়ে ছিল স্বপ্নের জাল বোনা।
কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাকটা সে টের পেল রবিবার। তখন প্রত্যয়রা স্রোতহীন ভাগীরথীর জল বেশ কয়েক কিলোমিটার পেছনে ঠেলে এগিয়ে গিয়েছে জয়ের দুয়ারে। প্রায় সাত থেকে সাড়ে সাত ঘন্টা জল সরিয়ে সরিয়ে তপু একসময় পিছনে ফেলে দিয়েছিল স্পেনের মাইকেল আর্টিগাকে। ২১ জনের মধ্যে চার নম্বরে ছিল তপু। তখনই দূর্বল শরীরের বাম অংশে ক্র্যাম্প ধরে যায়। শুরু হয়ে যায় শ্বাসকষ্ট। কিছুক্ষণ জলের সঙ্গে লড়াই করে মাঝপথেই তাঁকে ছিটকে যেতে হয় বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিযোগিতা থেকে।
অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। জলে নামার আগে তাঁর শরীরের পরীক্ষা হয়েছিল নিয়মমাফিক। চিকিৎসকের ফিট শংসাপত্র পেয়েই সে জলে নেমেছিল। তবে কি ঘাটতি ছিল সেখানেই? মুর্শিদাবাদ সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্রনাথ দাস বলেন, “এটা হতেই পারে। কার কখন পায়ে ক্র্যাম্প ধরবে তা বলা মুশকিল।” জল থেকে ওঠার পর চিকিৎসকরা তাঁকে ওষুধ দেয়। তপুর দাবি, ” সেই ওষুধ খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীরটা এখন ভাল লাগছে।” কিন্তু চোখের জল বাগ মানেনি।

বহরমপুর শহরে আছে অনেক কিছু। আবার গভীরে ঢুকলে শুধু নেই আর নেই। খেলার মাঠ আছে। তা খেলার উপযুক্ত নয়। রকমারি স্কুল গেমস। অথচ পরিকাঠামো দিকে তাকালে দেখা যায় তার কঙ্কালসার চেহারা। সাঁতার নিয়ে উন্মাদনা আছে অথচ সরকারি কোনও সুইমিং পুল নেই। হচ্ছে হবে করে এক সুইমিং পুল নিয়ে কেটে গিয়েছে প্রায় দু’টো যুগ। জল পোকা তপু তাই প্র্যাকটিসের জন্য বেছে নিয়েছিল জজ কোর্টের পিছনের একটি পুকুর। সেখানে সাঁতার কাটতে কাটতে দুচোখে ভেসেছিল যুদ্ধ জয়ের ছবি।
তপুর বাবার মাছ বিক্রি করা পেশা। মা ঠিকে ঝি। তপু পড়াশোনার পাশাপাশি শহরের একটি সুইমিং পুলে সাঁতার শিখিয়ে দু-পয়সা রোজগার করে। সেই ক্লাবই তাকে সাহায্য করে টুকটাক। কিন্তু তাতে এক তরতাজা যুবকের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির কতটুকুই বা ঘাটতি পূরণ হয়। দেবেন্দ্রনাথ বলেন,” আমাদের কাছে তো আসে না। আমরা ওদের মতো প্রতিভাবানদের সাহায্য করতে রাজি। ওরা আমাদের গর্ব।” তপুর একজন প্রশিক্ষক আছেন। কিন্তু তিনিই বা কতটুকু করতে পারবেন।
ভাগীরথীর তীরে দাঁড়িয়ে আক্ষেপের সুরে জয়জিৎ বিশ্বাস বলছিলেন ” যে রাজ্যে জন প্রতিনিধিরা অসামাজিক কাজকারবারে যুক্ত সেখানে এইরকম সামাজিক কাজ কারবারে এগিয়ে আসবেন কে? এ লড়াই ভাতের লড়াই। এ লড়াই টেকার লড়াই। এ লড়াই একলা লড়তে হয়। এখানে ক্যামেরা ঝলকায় না।” তপুরা কান পেতে শোনে। টিকে থাকতে মুখ বন্ধ রেখে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে ফের জলে ঝাঁপায়।
বাহ! দারুণ। অসাধারণ লেখনী।
তপুর মধ্যে ফাইট করার মানসিকতা আছে, ও সুযোগ পেলে ভাল ফল করতে পারবে , কিন্ত পজিশন পেয়ে কী হবে? দু বছর আগে যখন 81 কিমি সাতারে দ্বিতীয় হয়েছিল তখন ওকে কে কী সাহায্য করেছে? কিছুদিন ভাইরাল হয়েছিল। ওকে কী নুনতম একটা কাজ দেওয়া যেত না। ওর একটা সমস্যা অর্থের, ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। তপুর মতো অনেক ছেলে মেয়ে গান্ধী কলোনির মধ্যে আছে শুধুমাত্র খীর দার অভাব। অপনারা একটু চেষ্টা করুন প্রত্যয় আমাদের শহরেই জন্মাবে।
ওরা দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই করে। ওরা হারিয়ে গেলেও আবার ফিরে আসে। তপুর প্রতি রইল শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা। বহরমপুর থেকে সন্তোষ চ্যাটার্জি।