চল্লিশের দশকে ‘নবান্নের’ অভাবনীয় সাফল্যের পর নবনাট্য আন্দোলনের শ্লোগান শোনা গেছে। অনেকাংশে প্রেরণা ও প্রয়োজন ছিল মার্কসবাদী রাজনীতিরই।

স্নেহাশিস সৈয়দঃ বাংলার আধুনিক থিয়েটারে নাটক ও নাট্যরীতি নিয়ে বিগত কয়েকটি দশক যাবৎ নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। চল্লিশের দশকে ‘নবান্নের’ অভাবনীয় সাফল্যের পর নবনাট্য আন্দোলনের শ্লোগান শোনা গেছে। অনেকাংশে প্রেরণা ও প্রয়োজন ছিল মার্কসবাদী রাজনীতিরই। তারপর মঞ্চরীতি ভাঙা, দর্শকের ভেতর থেকে অভিনেতার প্রবেশ, সেটবর্জন কিংবা প্রতীকী সেট, নাটকে নাট্যকারের আবির্ভাব অর্থাৎ মায়া ও বাস্তবের ব্যবধান ঘোচানো, দর্শকের সঙ্গে কমিউনিকেশন, নতুন-নতুন অভিনয় রীতি, ধ্রুপদী গ্রিক ও সংস্কৃত নাট্যরীতি এবং এধরনের অসংখ্য নাট্যপ্রক্রিয়া চক্ষুগোচর হয়েছে। ভোট-রাজনীতির প্রয়োজনে পথে-ঘাটে-হাটে-মিটিঙে পোস্টার ড্রামাও দেখা গেছে ।শেষে এল ব্রেখটীয় রীতি। ইদানীং আবার লিভিং থিয়েটার, থার্ড থিয়েটার এসব জিনিস।
আমি হাসব, না কাঁদব ভেবেই পেলাম না। তারাশংকরের একটি উপন্যাসেও ঠিক ওই বাক্যটি দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।
এই দীর্ঘ ধারাবাহিক নাট্য প্রক্রিয়াকে আধুনিক নাগরিক জীবন-সংস্কৃতির জোরালো প্রাণের লক্ষণ বলে স্বীকার না করার কারণ নেই। তাছাড়া মুখ্যত এ সবই সামাজিক প্রতিবাদমূলক। তাই প্রায় সব নাটকই প্রতিবাদের নাটক এবং প্রচ্ছন্নভাবে অথবা প্রকাশ্যভাবে মার্কসবাদী দর্শনের বৃত্তাশ্রিত। অবশ্য কিছু নাটকে তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদ, সংকট কিংবা শূন্যতা, মূল্যবোধের সাংঘাতিক পতন, সামাজিক সম্পর্কের অবক্ষয়, নর-নারীর নতুন সম্পর্ক ইত্যাদি বিবিধ ‘বুর্জোয়া পাতিবুর্জোয়া’ থেকেছে।ব্রেখটীয় নাট্যক্রিয়াও যেমন, তেমনি ইদানীং কালের “থার্ড থিয়েটার “-ও এ ব্যাপারে স্পষ্ট ;বরং বলা যেতে পারে স্পষ্টতর উচ্চারণে দ্বিধাহীন ঘোষণায় পিছপা নয়।
দর্শককে নাটকে শামিল করা অর্থাৎ নাটকের চরিত্র গুলোর সঙ্গে দর্শকদের জড়িয়ে ফেলার কমিউনিকেশন ঘটানোর কিছু পদ্ধতি চারের দশক থেকেই দেখা গেছে গণনাট্যসংঘের অনুষ্ঠানে। অভিনেতারা চরিত্র অনুযায়ী সাজেন না। যে বেশে এসেছেন, সেই বেশেই নাটকে অবতীর্ণ হন। কদাচিৎ একটা গামছা বা টুপি দরকার হয়। আবহসংগীত মুখে, বা কখনও একটা ঢোলকে। বহুজিনিস দেহভঙ্গিমায় বোঝানো হয়। দর্শকদের ভেতর গিয়ে অভিনয় করা হয়। থার্ড থিয়েটারের প্রকরণিক ব্যুৎপত্তি হল এই: একদিকে বিলেত থেকে আনা মঞ্চরীতির থিয়েটার, অন্যদিকে ‘পশ্চিমবঙ্গে যার নাম তর্জা, যাত্রা, গম্ভীরা, মহারাষ্ট্রে যার নাম তামাশা, উত্তরপ্রদেশে যার নাম নৌটোস্কি বা রামলীলা, দক্ষিণভারতে কর্ণটিকে যার নাম যক্ষগান, সেই সব দেশী লোকনাট্য যথাক্রমে ফার্স্ট এবং সেকেণ্ড থিয়েটার। এই দুই রীতির বাইরে থার্ড থিয়েটার, যাতে দরজার প্রতীকও দুই অভিনেতা এবং তাঁরা মুখে ক্যাঁচ শব্দ করলে দরজা খোলা বোঝায়। এ মেট্রপলিসে নিশ্চয় নতুন নাট্যপ্রক্রিয়া।
অভিনেতারা চরিত্র অনুযায়ী সাজেন না। যে বেশে এসেছেন, সেই বেশেই নাটকে অবতীর্ণ হন। কদাচিৎ একটা গামছা বা টুপি দরকার হয়।
দিশী লোকনাটোর সঙ্গে তর্জার নাম রয়েছে। তাহলে আউল-বাউলই বা বাদ গেল কেন? আউল-বাউলরাও অনেকসময় কবির লড়াইয়ের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আসর করেন এবং দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে বাক্যালাপ করেন সম্ভবত তর্জা কথাটাও কোন সায়েবেন কাছে পাওয়া। করুণা ও কৌতুকের উদ্রেক হয়। আলকাপ ছিল দর্শকেরই নাটক। আলকাপ ছিল দর্শকের নাটক। প্রচুর গ্রন্থিরসের স্মরণে আবিষ্ট থেকেছেন উভয়পক্ষ। বস্তুত সব নাটকের এটাই একান্ত উদ্দেশ্য। সব নাট্য প্রক্রিয়ার লক্ষ্য এই আবেশ, এই চরম তৃপ্তি- প্রেমিক নরনারীর শারীরিক মিলনের মতো।
কিন্তু আলকাপ নাট্যরীতি যে সব চেয়ে বৈপ্লবিক এবং গতিশীল, একথা বোঝবার জন্য প্রকৃতপক্ষে স্বদেশ গমনেরই প্রয়োজন ছিল। নগর থিয়েটার কদাচ স্বদেশমুখী হয়নি। তাহলে বিদেশে হাত বাড়াতে হত না।সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ জানাচ্ছেন, বহু বছর পর কলকাতা এসে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক একটা কেতাবে দেখি, ছাপা হরফে লেখা আছে: ‘আলকাপ মুসলিম চাষীদের গান।’ নমুনাস্বরূপ কয়েকটি ছড়াও আছে।
আমি হাসব, না কাঁদব ভেবেই পেলাম না। তারাশংকরের একটি উপন্যাসেও ঠিক ওই বাক্যটি দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ওর গ্রাম ছিল লাভপুর। লাভপুর এলাকায় অসংখ্য আলকাপ দল ছিল। অসংখ্য আসর বসেছে বহুকাল ধরে। আমি লাভপুরে, পাশের গ্রাম পুশুলিয়ায় এবং এলাকার আরও বহু গ্রামে আসর করেছি। সঙ্গে ছিল সেই সঙাল লাতু। কিন্তু ‘হাঁসুলি বাকের উপকথার’ লেখকেরও কেন এই ভুল হয়?
কোথাও একটা গভীর বিচ্ছিন্নতা আছে। আছে অবহেলা ও ঔদাসীন্য। হয়তো বহুযুগের বর্ণাশ্রমশাসিত অবচেতনা, পুরুষানুক্রম বৈদেশিক দাসত্ব, কিংবা হয়তো জাতীয় চরিত্রে।
কোথাও একটা গভীর বিচ্ছিন্নতা আছে। আছে অবহেলা ও ঔদাসীন্য। হয়তো বহুযুগের বর্ণাশ্রমশাসিত অবচেতনা, পুরুষানুক্রম বৈদেশিক দাসত্ব, কিংবা হয়তো জাতীয় চরিত্রে। নিহিত আছে বিশাল এক জাড্য-যা কেবলই বাইরের উচ্ছিষ্ট কুড়োতে এবং তস্করবৃত্তিতে প্ররোচিত করে। বিশাল এক ককেশিয়ান চক সার্কেল জেগে উঠতে পারত আলকাপ-বৃত্ত থেকে। জাগেনি।