
সন্দীপন মজুমদারঃ ঠিক, এ নিয়ে কোনো মতান্তরই নেই যে গত ২৯ শে মার্চ বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে উৎপল দত্তর জন্মদিনে বহরমপুরের তিন নাট্যদল ঋত্বিক, যুগাগ্নি এবং সুহৃদের যৌথ প্রযোজনায় এবং ঋত্বিকের বিপ্লব দে, যুগাগ্নির দেবাশিস স্যান্যাল এবং সুহৃদের হরপ্রসাদ দাসের পরিচালনায় যে মঞ্চস্থ হল উৎপল দত্তর লেখা নাটক রাইফেল – তা এই শহর তথা জেলার নাটকের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
থিয়েটার যেহেতু কালেকটিভ আর্ট– – সেখানে সমন্বয়, বিনিময়, আদানপ্রদান যত হয় ততই ভালো। থিয়েটারের স্বার্থে এটা জরুরী ।বিশেষত যদি বড় মাপের কোনো প্রযোজনা করতে হয়, সেখানে এটা প্রয়োজনীয় রিসোর্স জোগাতে সাহায্য করে। এই সম্ভাবনা কলকাতার তুলনায় মফস্বল শহরগুলোতে বেশি করে সম্ভব, বিশেষত বহরমপুরের মত শহরে। এখানে নাট্যদলগুলির মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে এই সম্পর্ক , তা সে ব্যক্তিগত স্তরেই হোক বা সাংগঠনিক আগে থেকেই বিদ্যমান। ফলে ‘রাইফেল’ প্রযোজনা এই সম্পর্ককে একটা সৃষ্টিশীল, গতিময় অভিমুখ দিল।

কেমন হল ‘ রাইফেল’ প্রযোজনা ? যে প্রযোজনায় এতগুলি গুণী মানুষ একত্রিত হয়েছেন, বহরমপুরের বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনয় করছেন তা প্রযোজনা নৈপুণ্যে সিদ্ধিলাভ করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। মঞ্চ, পোষাক, আলো, রূপসজ্জা সবকিছুই যথাযথ। অর্থাৎ যে পরীক্ষায় তাঁরা বসেছিলেন তাতে তাঁরা সসম্মানে উত্তীর্ণ। কিন্তু যে প্রশ্নপত্রটি তাঁরা পেয়েছেন তার সিলেবাস অনেকটাই বদলে গেছে। আমাদের সমালোচনার জায়গাটা সেখানে।
পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমরা কী বলতে চাইছি । উৎপল দত্ত এই নাটকটি লেখেন ১৯৬৮ সালে। এটি তাঁর নিজস্ব ঘরানার রাজনৈতিক নাটক । এই ধরণের নাটকে আমরা দেখেছি উৎপলবাবু একটি নির্দিষ্ট কালখণ্ডের ইতিহাসকে ধরে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করতেন। সমস্ত নাট্যগুণ বজায় রাখার পরও এই নাটকগুলি প্রপাগান্ডিস্ট। তাতে আলাদা করে অসুবিধার কিছু নেই। তাঁর সমকালে যে রাজনৈতিক মতাদর্শ তার প্রচারে নাটকগুলি সাফল্য পেয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু মুশকিল হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নাটকগুলির রাজনৈতিক বক্তব্য প্রাসঙ্গিকতা হারায়। কারণ উৎপলবাবুর বক্তব্য চিরন্তন রাজনৈতিক বিষয় যেমন স্বৈরাচার, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি থীমকেন্দ্রিক হয় না।

ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর মত নাটক। এটিও একটি রাজনৈতিক নাটক কিন্তু যুগে যুগে এর থীমগুলি নতুন প্রাসঙ্গিকতায় ধরা দিতে পারে। শেকসপীয়ারের ইতিহাস আশ্রিত নাটকগুলিতেও ইতিহাসের স্থান গৌণ ,ব্যক্তিচরিত্রের দ্বন্দ্বই মুখ্য। ফলে লেডি ম্যাকবেথের লোভ ও উচ্চাকাঙ্খা অথবা হ্যামলেটের দ্বিধাজড়িত ব্যক্তিত্ব– এইসবের সঙ্গে সমন্বিত হতে আমাদের বিশেষ অসুবিধা থাকে না। কিন্তু ‘রাইফেল’এর মত নাটকে ইতিহাসের বিশেষ কালখণ্ডের প্রাধান্য খুব বেশি হওয়ায় সর্বকালে প্রাসঙ্গিক থাকার সুযোগ সময়ের ব্যবধানে ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে।
যে সময়ে উৎপল দত্ত এই নাটক লিখেছেন তখন আর্থিক স্বাধীনতার সন্ধানে ভারতের শ্রমিক, কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করাই ছিল বিবেকবান শিল্পীদের মূল লক্ষ্য। সবকিছু মোটামুটি সাদা কালোর বিভাজনে দেখাটাই তখন ছিল দস্তুর। কিন্তু আজ পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের চেতনার সেই নিষ্পলক একাগ্রতা আর নেই। আমরা জেনেছি শ্রমিক কৃষকের নেতৃত্ব কীভাবে আদর্শচ্যুত হতে পারে। আমরা জেনেছি গান্ধীবাদী দর্শন নিজেই আজ আক্রান্ত, উঠে এসেছে তার দর্শনকে আক্রমণ করে ফ্যাসিবাদী প্রচ্ছায়ার বৃহত্তর বিপদ।

সামাজিক মাধ্যম কীভাবে শ্রেণীঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতা আর উদাসীন নির্লিপ্তিকে পরিপুষ্ট করে চলেছে, তা আজ অনেক বড় রাজনীতির বিষয় । এমনকি উৎপলবাবু যেভাবে এই নাটকে স্বাধীনতা সংগ্রামের চরমপন্থী ধারাকে দেখিয়েছেন তার মহনীয়তাকে স্বীকার করেও অনেক প্রশ্ন উঠছে। বলা হচ্ছে কালীর কাছে শপথ নিয়ে , গীতা পাঠ করে যেভাবে এই চরমপন্থী দলগুলির কার্যকলাপ পরিচালিত হত তাতে রহমত আলীর মত মুসলমানদের সেখানে অংশগ্রহণ খুব স্বাভাবিক ছিল কিনা । যদিও সূর্য সেন অথবা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস , উভয়েই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। তাই এই নাটকের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা, ঐতিহাসিক কিছু গুরুত্ব ছাড়া আজ অনেকটাই ক্ষীণ।
উৎপল দত্ত আঙ্গিকের প্রয়োগের বিষয়ে ধ্রুপদী ছিলেন। প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা তিনি করেছেন, কিন্তু সেগুলি প্রচলিত নাট্য আঙ্গিকের সীমারেখাকে মেনেই। তাঁর সহায়ক ছিলেন বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান নাট্যকুশলী। কিন্তু রাইফেল (মূলত পালা হিসেবেই লেখা হয়েছিল বলেই শুধু নয় ) বা অনুরূপ নাটকে নাট্যমুহূর্তের বিশেষ ঘনীভূত আবেগ উৎপাদনকেই উৎপলবাবু দর্শকের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের সবচেয়ে সহজ উপায় বলে ভেবেছিলেন।
শেকসপীয়ারের ইতিহাস আশ্রিত নাটকগুলিতেও ইতিহাসের স্থান গৌণ ,ব্যক্তিচরিত্রের দ্বন্দ্বই মুখ্য। ফলে লেডি ম্যাকবেথের লোভ ও উচ্চাকাঙ্খা অথবা হ্যামলেটের দ্বিধাজড়িত ব্যক্তিত্ব– এইসবের সঙ্গে সমন্বিত হতে আমাদের বিশেষ অসুবিধা থাকে না।
বিশ্লেষণ, বৌদ্ধিক আবেদন বা আঙ্গিকের জটিলতার পথে হাঁটেন নি একদমই। এবার সেই সময়ে এই আবেগ যেভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল আজকের দর্শককে আর তা সেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারে না। কিন্তু ১৯৬৮ সালের রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে যদি ২০২৫ সালের বাস্তবতাকে কোনোভাবে সমন্বিত করতে হয় , তাহলে সেটুকু কাজ অত্যাবশক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ আজকে রাইফেলকে প্রাসঙ্গিক করতে হলে এই টেক্সটকে ভেঙ্গে আবার গড়েপিটে নেওয়া দরকার ছিল, শুধু দায়বদ্ধ অনুসরণ নয়। সেই কাজ আরো কঠিন।বিকল্প পথ ছিল এই নাটকটিই নির্বাচন না করা।
যৌথতার দায় মেটাতে গেলে শুধু সম্মতি নয়– প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্নে অস্থির হতে হবে নিজেদের, দর্শককেও টেনে আনতে হবে সেই বৃত্তে। বিশেষত যখন মানবতার শত্রুদের হাতে আজকে আর রাইফেল নয়, গণবিধ্বংসী অনেক অস্ত্র আছে, আছে গণচেতনা বিনষ্টির অনেক অদৃশ্য পাশুপত অস্ত্র।

লেখক একজন নাট্যকার, সমালোচক, চিন্তক, সুবক্তাও। একজন নিবিড় পাঠক শুধু নন সন্দীপন মজুমদারের খ্যাতি তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণেও। জেলা তথা রাজ্যে সাড়া ফেলা ‘সিনেমা ভাবনা’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদকও তিনি।