অনলদা’র লেখা একের পর এক এক্সক্লুসিভ স্টোরি ও ফিচার আনন্দবাজার পত্রিকার বিক্রি অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল

Social Share

শুভাশিস সৈয়দ, বহরমপুরঃ নারকেলের ভেতরের জলের তলায় কতটুকু শাঁস রয়েছে, তা দেখার যার যত ভাল চোখ রয়েছে, সে তত ভাল রিপোর্টার–বলতেন অনল আবেদিন। প্রতীকী ওই শব্দ ব্যবহার করে আসলে তিনি বোঝাতে চাইতেন খবরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা খবরের সুলুকসন্ধান করার কথা। খবরের ভেতর খবর খুঁজে বের করে সেই খবরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দিনের পর দিন খবর করতেন বলেই তিনি আজকের অনল আবেদিন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

সেই অনল আবেদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন। মৃত্যুর সময় রেখে গেলেন দুই কন্যা অন্বেষা ও বর্ণমালা এবং স্ত্রী তন্দ্রা বিশ্বাসকে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ কয়েক দশকের সম্পর্ক। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই চিনি অনল আবেদিনকে। আমার বাবাকে ‘দাদা’ সম্বোধন করতেন বলে আমি ‘কাকু’ বলে ডাকতাম। তার অনেক পরে আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর সহকর্মী হিসেবে যোগ দিই। মনে আছে–বহরমপুর বানজেটিয়ায় আনন্দবাজার অফিসে যাওয়ার প্রথম দিনই আমাকে বলে দেওয়া হয়–“শোন এখন থেকে আমি কিন্তু কাকু নই। কাকু বলে ডাকলেই পিছনে লাথি খাবি। আমাকে দাদা বলে ডাকবি।” তার পর থেকে অনল কাকু হয়ে গেল অনলদা। যদিও অনলদা’র বউকে কাকিমা বলে ডাকতাম।

২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত এক সঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করেছি আনন্দবাজারের বানজেটিয়া অফিসে। পরে আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতা অফিসে আমার বদলি হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত কারণে দেখা-সাক্ষাতে ছেদ পড়ে। তবে এই যে বহরমপুর লাগোয়া বানজেটিয়া এলাকায় আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী অফিস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল অনলদা’র। সেই সময়ে অনলদা’র লেখা একের পর এক এক্সক্লুসিভ স্টোরি ও ফিচার আনন্দবাজার পত্রিকার বিক্রি অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল।

আসলে আনন্দবাজারে অনলদা যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত জেলার সাংবাদিকতা ছিল পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভর। দিনের শেষে বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকেরা মিলে জেলা পুলিশ সুপারের অফিসে যেতেন। সারা দিনের ঘটনা/দুর্ঘটনা জেলা পুলিশ সুপার জানাতেন এবং পরের দিন কাগজে তাই প্রকাশিত হত। অনলদা এই রীতি ভেঙে দিয়ে নিজের মতো করে জেলা চষে খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করতেন।

একের পর এক খবর–সে পদ্মায় বিএসএফের তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা, মাটি-মাফিয়ার মত ধারাবাহিক অথবা দু’হাজার সালের বন্যার দুঃসাহসিক ছবি-প্রতিবেদন সাংবাদিকতা ভাষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন তিনি। এই যে সালিশি-সভা’র খবর পড়ি আমরা, তা অনলদা’র হাত ধরে সাংবাদিকতা জগতে ঠাঁই পেয়েছে।অনলদা জানিয়েছিলেন, ‘সালিশি সভা’ শব্দ দুটি খবরের কাগজে তিনিই প্রথম লেখেন। সেই সুবাদে তাঁর আবিষ্কার ‘সালিশি সভা’।

নব্বই দশকের শুরুর দিকে লাল রঙের সেকেন্ড হ্যান্ড একটি সাইকেলে চড়ে তিনি খবর সংগ্রহ করতেন। ঝড়, মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ, ওভারল্যান্ড দৈনিক পত্রিকার লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত আনন্দবাজার পত্রিকায় থিতু হন তিনি। যদিও শুরুতে অনলদা সাংবাদিক ছিলেন না। ছিলেন ফটোগ্রাফার। ওভারল্যান্ডে ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ হয়েছিল তাঁর।

সেই সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় কোনও ফটোগ্রাফার যেমন ছিল না, তেমনি ডিজিট্যাল ক্যামেরাও ছিল না। ফলে একই সঙ্গে ফিল্মের রোল ক্যামেরায় পুরে ছবি তুলতে হত এবং খবরও সংগ্রহ করতে হত তাঁকে। সে এক আসাধ্যসাধন কাজ বলা যায়! আর একটা না বললেই নয়, সেটা হলো–খবর লেখার সময়ে নির্বিকার ধ্যানস্থ ঋষি হয়ে যেতেন অনলদা। সেখানে কোনও পক্ষপাত ছিল না। প্রকৃত খবর তুলে ধরার চেষ্টা করতেন তিনি।

অনলদাকে ঘিরে এত স্মৃতি, এত কথা কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না। সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তবে ভাই কাম কাছের বন্ধু হিসেবে আমার প্রতি যেমন বিশ্বাস ছিল তেমনি গাঢ় ভালবাসাও ছিল। আবার ভুল বোঝাবুঝিও কম ছিল না। তবে মতান্তর হলেও কোনও দিন মনান্তর হয়নি। এ নিয়ে ই-টিভি’র প্রয়াত সাংবাদিক কাম ক্যামেরাম্যান মিলন মণ্ডল মজা করে বলতেন–“৩৪ বছর সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্ব আর অনলের সঙ্গে শুভাশিসের ঝগড়া-বিবাদ না হওয়াটাও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে।”

লেখা শেষ করার আগে আনন্দবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক প্রসূন আচার্যের লেখার অংশ তুলে শেষ করব। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অনলদাকে দেখতে গিয়ে সেখানেই আমাকে ফোন করে প্রসূন দা বিস্তারিত জানতে চান। পরে প্রসূন দা ফেসবুকে তাঁর পেজে লেখেন–“অনল ছিল একজন সেক্যুলার, গনতান্ত্রিক অধিকার সচেতন মানুষ এবং এই নিয়ে আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। যে একই সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে। এই দুয়ের বিরুদ্ধেই সমান ভাবে ওর কলম চলতো। ইদানিং কালে সাংবাদিকদের অধোগতি, তাদের কর্ম ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা একই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব ছিল। ভালো গল্প লিখতো। আর সন্ধ্যার আড্ডায় অনলের কোনও বিকল্প নেই। জেলা , অতীত ও সমকালীন রাজনীতি ও ইতিহাসে ওর দক্ষতায় ঈর্ষা করার মত। সেই সঙ্গে রেফারেন্স।” অনলদা চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলা সাংবাদিকতা ইতিহাসের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল…

লেখকঃ প্রাক্তন সাংবাদিক, আনন্দবাজার পত্রিকা (মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights