বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির দুই সেনাপতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও সীতারাম ইয়েচুরি পিঠোপিঠি এক কঠিন সময়ে প্রয়াত হয়েছেন। এমন সময় যখন দল আন্দোলনমুখী। সেই আন্দোলনকে ধরে রাখার, সংগঠনকে ধরে রাখার জন্য নেতার প্রয়োজন রয়েছে। দিক নির্দেশকের প্রয়োজন রয়েছে। দূরে দূরে থাকা শরিকদের ফের এক ছাতার তলায় আনার প্রয়োজন রয়েছে দলেরই স্বার্থে। সেই কাজ যদিও একটু একটু করে শুরুও হয়েছে আরজিকর আবহে। শরিকরা আসছেনও। শোক তাঁদেরও। আর তাই গ্রাম থেকে শহর ফের জেগে উঠবার ডাক দিয়েছেন শরিকদের এ, ও, সে। শাসকের অন্দরে খবর পৌঁছেছে আরজিকর কান্ড নিয়ে গেরুয়া বাহিনী নয়, ঘাসফুল শিবিরে সতর্কতার লাল নিশান উড়িয়েছে বামেরাই।
তবে দু’মাসের কাছাকাছি এই আন্দোলন চললেও সমাজের একেবারে নিচুতলায় সেই আন্দোলনকে পৌঁছে দেওয়া যায়নি নানান কারণে। গ্রাম-শহরকে এক বন্ধনিতে আনাও সম্ভব হয়নি। শুধু আরজিকর কান্ড কেন ? শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি থেকে রেশন কান্ড যা কার্যত খাদের কিনারে পশ্চিমবঙ্গকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগও বামফ্রন্ট পক্ষে টানতে পারেনি সক্রিয় কর্মীর অভাবে। ইভিএমেও তার প্রভাব পরেনি।

অথচ বহরে বড় দল সিপিআইএম। কিন্তু ত্যাগের বদলে ভোগের প্রবণতা গ্রাস করেছে তাঁদের একাংশকে। তার প্রভাব দলে পড়েছে। পার্টিকে ব্যবহার করে কেউ কেউ আখের গুছিয়েছেন নিজের, আর তা তাঁদের পার্টির প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নকেই বড় করে তুলেছে। যা আখেরে ক্ষতি করেছে পার্টির। লক্ষ্য চলে গিয়েছে দূরে। মুর্শিদাবাদে প্রয়াত দুই নেতার স্মরণ সভায় এসে শনিবার তাই বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলে গেলেন, “বুদ্ধদেব, সীতারামের পথে যেতে গেলে এই গয়ংগচ্ছ মানসিকতা ছাড়তে হবে।”
পার্টির প্রতি প্রয়াত দুই নেতার দায়বদ্ধতার উদাহরণ টেনে এদিন বিমান বাবুর আক্ষেপ, ” যারা সিপি (আই)এম করেন তাঁরা পার্টির কথা ভাবেন? যদি ভাবতেন তাহলে হয়ত পশ্চিমবাংলার যে বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি তা পরিবর্তনের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতেন।” তিনি আরও বলেন, “কমিউনিস্ট পার্টি ব্যক্তিগত জীবন গোছানোর জন্য পার্টি নয়। কেউ কেউ গোছানোর চেষ্টা করেন। পার্টির সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকেন। কিন্তু যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সীতারাম ইয়েচুরির প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা জানানোর মনোভাব থাকে তাহলে তাদের সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া উচিত।”
জেলায় ফি সপ্তাহে শাসকদলের খাতায় নাম লেখানোর খবর চলে আসে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে। মুখ বাঁচাতে নেতারা দল বদলানো সেই নেতা-কর্মীর ভোগের দিকটিকেই বড় করে তোলেন। আর তা নিয়ে পার ভাঙতে ভাঙতে পুরো বাড়িটা ভেঙে পড়বার কথা ভিড় করে আসে কমেন্ট বক্সে। তখন মন থেকে উধাও হয়ে যায় তত্ব কথা। বুদ্ধদেব ও সীতারামের যুগের সঙ্গে ২০২৪-এর বহুত ফারাক। ক্রমশ কিছুর বদলে কিছুর প্রত্যাশায় নিমজ্জিত সমাজ। সেই সময় ত্যাগ আর মোহ শব্দ দু’টিকে বড় অবহেলায় ব্যবহার হতে হয়। তবু তাকে দূরে সরিয়ে কমিউনিস্ট মানসিকতাতেই বিমানবাবুরা চাইছেন, দল সংযমে ফিরুক। সেও কী সম্ভব? কানায় কানায় ভরে থাকা জেলাপরিষদের অডিটোরিয়ামে উপস্থিত পার্টির কর্মীরা, জেলার দায়িত্বে থাকা নেতাদের কেউ কেউ সেই প্রশ্ন বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আকাশ তখন দৃশ্যতই মেঘলা।