বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ ভারতের ছাত্র ফেডারেশন বা এসএফআই-এর একজন সক্রিয় কর্মী সফদার হাসমিকে মেরে ফেলা হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ২ জানুয়ারি। মাত্র ৩৪ বছরের জীবনকালে হাসমি লিখে গিয়েছেন বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় নাটক। তারমধ্যে অন্যতম “আওরাত”।
তাঁর মৃত্যুর প্রায় ছ’বছর পরে ১৯৯৫ সালে সেই নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন আশিস গোস্বামী ও সীমা সরকার। যুগাগ্নি নাট্যসংস্থার তৎকালীন পরিচালক অভিজিৎ সরকার পথ নাটক হিসেবে তাঁদের মহলাকক্ষের সামনেই সে বছর ১২ এপ্রিল প্রথম মঞ্চস্থ করেন নাটকটি। ওই নাটকের ১৭৭ তম শো মঞ্চস্থ হল সম্প্রতি। সংস্থার বর্তমান পরিচালক দেবাশিস স্যান্যাল বললেন, “দুর্ভাগ্য। এই নাটক আজও প্রাসঙ্গিক।”
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?/ নত করি মাথা পথপ্রান্তে কেন রব জাগি/ ক্লান্তধৈর্য প্রত্যাশার পূরণের লাগি /দৈবাগত দিনে।” “আওরাত” নাটকে নারী স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন হাসমিও। দেবাশিস বলছেন,”আমরা মুখে পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নারী এখনও সেই পুরুষের ইচ্ছেতেই স্বাধীন। আর তাই এই নাটক এখনও প্রাসঙ্গিক।” আরজিকর হাসপাতালে কর্মরত পড়ুয়া চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণ কান্ডে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নই ফের জোরাল হয়েছে নগরে, প্রান্তরে।
সরকারের খাতায় মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা? এখনও দেশের প্রায় প্রতি গ্রামে নাবালিকা বিয়ে হয়ে যায় গোপনে। পণের দায়ে অসময়ে ঝরে পরে কত প্রাণ? কোথায় লেখা থাকে সেই খতিয়ান?
ইউনিসেফের হিসেবে বিশ্বের প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন ভারতের বালিকা বধূ। ভারত সরকার মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স বাড়িয়ে ২১ করেছে। চলতি বছর জুলাইতে প্রকাশিত ”ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রোটেকশন’ গবেষণা দলের একটি নতুন গবেষণার সামনে এসেছে। Times of India তা প্রকাশ করে জানিয়েছিল ভারতে প্রতি মিনিটে তিনটি মেয়ে শিশুকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে পুরুষের বয়স ২১-এর বেশি। ওই সংবাদ সংস্থাকে গবেষণা দলটি এটাও জানিয়েছিল সব অপরাধ নথিভুক্ত হয় না।
শুধু কী তাই? এখনও মেয়েদের রাত বিরেতে একলা চলায় মানা। তাতে রাষ্ট্রেরও ইন্ধন আছে? তা না হলে মেয়েদের রাত বিরেতে ডিউটি দেওয়ার ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করার নির্দেশ কেন জারি হয়। আর সেই প্রশ্নেই জেরবার হতে হয় রাজ্যকে, শীর্ষ আদালতে। গত বুধবার টেক্সটাইল মোড়ের পথ মধ্যে যুগাগ্নির ‘আমি মেয়ে’ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে দলের সদস্য অনুপম ভট্টাচার্য সেই প্রশ্নই তুলেছিলেন। তাঁর সেই প্রশ্নের পাল্টা জবাব দেন ‘বহরমপুর অ আ ক খ’ দলের তরুণী, ওপার বাংলার সঙ্গীতশিল্পী ফরজানা ওয়াজিদ সায়ানের লেখা “এই মেয়ে শোন এই রাত এই ভোর.. যতখানি পুরুষের ততখানি তোর” গান গেয়ে। তা সত্যি কি না তা নিয়ে ধন্দ থাকে।
শুধু যুগাগ্নিই নয়, আরজিকর কান্ডের প্রভাব পড়েছে মফস্বলের নাটকে। মেয়েকে জন্ম থেকে বড় করে তুলেও শান্তি নেই বাপ মায়ের। যেন আজও প্রতিধ্বনিত হয় ‘আমি মেয়ে’র সেই সংলাপ “ও মেয়ে। তাই হয় ওকে মারতে হবে, না হয় আমাকে মরতে হবে।” আরজিকর ঘটনার ছায়ায় সামিম আহমেদ লিখেছেন ‘এক নারী ও আমরা’ নাটকটি। ডাক্তারের মা হওয়ার গর্বের বদলে মায়ের কানে আসে ষড়যন্ত্রের শিকার সেই মেয়ের মৃত্যু সংবাদ। প্রান্তিক দত্তের নির্দেশনায় ও ‘বহরমপুর অ আ ক খ’-র প্রযোজনায় সেই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে একাধিকবার, বহরমপুরে ও মহালন্দীর পথে পথে। নাটকের আবেদন সাড়া ফেলেছে পথ চলতি মানুষের মনে।
প্রসেনিয়াম থিয়েটার ছেড়ে সময়ের ডাকে পথে নেমেছে প্রান্তিক নাট্যদলও। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা, লখিন্দরকে মনে আছে? সেই মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যকে সময়ের আয়নায় ফেলে চরিত্র বদলে তমোজিৎ রায় লিখেছেন ‘লখাই ভাসায় ভেলা।’ ২০২৪- এ লখিন্দর (লখাই) বেহুলার প্রাণ ভিক্ষা চাইতে বেরিয়েছে কোন ইন্দ্রপুরীতে? প্রাণ ফেরানো এযুগে অসম্ভব। বিচার চাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু বিচার দেবে কে? সত্যিই কি বিচার পাবে বেহুলা ? আরজিকর কান্ডের ছায়ায় রচিত হয়েছে এই নাটক ও। নাটকটি পরিচালনা করেছেন প্রিয়াঙ্কু শেখর দাস। আজ শহরের তিলোত্তমা চত্বরে ফের মঞ্চস্থ হবে সেই নাটক।

মেয়ে মানেই পুরুষের লালসার শিকার। পথে, ঘাটে, ট্রেনে বাসে সবক্ষেত্রে পুরুষের দুটো চোখকে সভয়ে এড়িয়ে বাঁচতে হয় একজন মেয়েকে। ধর্ষণ তো সেই মেয়েরই অমতে বলপূর্বক সঙ্গম। আর সেই ভয়েই নারীর একা বাইরে যেতে মানা। সে কথা বলতে বলতে বহরমপুরের এক স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ তাঁর রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন একবার বলেছিলেন, ” কেন গর্ভপাত সেই প্রশ্ন তোলে না বাড়ির লোক। আসল কারণ খোঁজে না সেই মেয়ের পুরুষ সঙ্গীটিও। তার লক্ষ্য শুধু স্ত্রী’র তিন অঙ্গেই।” রণ নাট্য সংস্থাও ‘দর্পণে গর্জন’ অংশ নিয়ে মঞ্চস্থ করেছে নাটক “ফিনিক্স।” এই নাটকটিও তমোজিতের লেখা। পরিচালনা করেছেন রণিতা লাহিড়ী।
আর এসবই দেখতে, দেখতে, শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আর কবে? আর কবে? মেয়েরা বলবে স্বাধীনভাবে ” যাব না বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী / আমারে প্রেমের বীর্যে করো অশঙ্কিনী/ বীরহস্তে বরমাল্য লব একদিন।” আরজিকর কান্ডের জেরে যে গণ আন্দোলন ১৪ অগস্ট দেখেছিল বঙ্গ, তা কি থিতিয়ে পড়ছে? ব্রিহির অন্যতম অভিনেতা বিকাশ সাহা নাটকের মঞ্চে অবশ্য গান গেয়ে বলেছেন ” থামালে চলবে না তোর ক্লান্ত পা …”