
বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ বহরমপুর শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেঁটে গেলে যা নজরে পড়বে আর যা অনুভূতি হবে তার ফারাক বিস্তর। শহর জুড়ে প্রাক বর্ষায় রাস্তার এক পাশ খোঁড়া হয়েছিল শহরবাসীকে ভরা বর্ষায় বৃষ্টি ও বর্জ্য মেশানো জমা জলের নাগপাশ থেকে রেহাই দিতে নিকাশিনালা তৈরির পরিকল্পনায়। কিন্তু সময়ে বর্ষা নেমে পুরসভাকে ফের পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে প্রকৃতি।
এবারও বৃষ্টির জল আর নর্দমার জল পায়ে ঠেলে নিজের রাস্তা নিজেই করে এগিয়ে গিয়েছেন পুরবাসী, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। যদিও কারও কারও প্রশ্ন ” নালা হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সেই নালা দিয়ে জল নামবে তো?” পুর প্রতিনিধিদের আশ্বাসে অবশ্য মিলছে ভরসার কথা। আর রাস্তা থেকে বেশ কয়েকশো ফুট উঁচুতে শহর ছেয়েছে তৃণমূলের পতাকায় আর ফ্লেক্সে। নজরে ‘একুশে জুলাই’ আনতে টক্কর চলছে পুরপ্রধান নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায় আর যুব নেতা ভীষ্মদেব কর্মকারদের দেওয়াল জোড়া হোর্ডিং, কাট আউট সহ আরও কত বাহারি বিজ্ঞাপণে।
রোজ সন্ধ্যায় আজ এ পাড়া কাল ওপাড়ায় পথ সভায় বক্তব্য রাখছেন পুরপ্রধান। শহর ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন গাঁয়ে, গঞ্জে বিধানসভায় তৃণমূলের চেয়ারম্যান হয়ে। ভীষ্মদেবেরও কর্মসূচির অন্ত নেই। আর সমাজমাধ্যমে কয়েক সেকেণ্ড নজর রাখলে হু হু করে নেমে আসছে সেই সব ভিডিও। এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায়। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন তা নিয়ে ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন নেতার অনুগামীরা। তবে একুশে জুলাইয়ের প্রচার মঞ্চ যে তৃণমূলের ভোট প্রচারের মঞ্চ হয়ে উঠেছে তা মানতে অবশ্য দ্বিধা নেই কারও।
অধীর চৌধুরীর মতো প্রবীণ নেতারা যতই বলুন না কেন ” একুশে জুলাই শহিদের নয়, তৃণমূল তাকে পিকনিক দিবসে পরিণত করেছে।”, ঘাসফুলের পতাকা বাহকদের সে কথায় হুঁশ নেই কোনও। মন্ত্রী ফিরহাদ তো বলেই গিয়েছেন বহরমপুরে ” কে অধীর চৌধুরী? ও তো এক্স হয়ে গিয়েছে।” প্রাণের ব্যারাক স্কোয়ারে এক ঝলক চোখ গেলে বাহারি আলো পর্যটকের নজর টানলেও মাঠের বুকজুড়ে বর্ষায় বেড়েছে আগাছা। জমেছে জল।” মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম থেকে সাধারণ খেটে মানুষের ভরসা তাই কংক্রীটের ফুটপাত। আগাছা মোড়ানোর দায় জেলা প্রশাসনের, পুরসভার নয়। এখানে আপাতত ব্যাকফুটে প্রশাসন। পিছিয়ে নেই অবশ্য তারাও।
আরও পড়ুনঃ সিপিএমের বারো জন সহ- সম্পাদকের কেউ নয় বহরমপুরের
শহরের ঐতিহ্যের সংস্কার করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ব্রিটিশের ফেলে যাওয়া ঘর বারন্দায় কোথাও মাংসের দোকান, কোথাও বইয়ের দোকান, কোথাও মিষ্টির দোকান, কোথাও ক্লাব ঘর কোথাও তৈরি হচ্ছে কফি হাউস। কথা আছে আর্ট গ্যালারি তৈরিরও। ছাব্বিশের বিধানসভার আগে শহর বহরমপুর সাজিয়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দু-পক্ষই। সেখানেও অবশ্য খোঁচা দিয়েছে বিরোধী। বহরমপুরের বিধায়ক বিজেপি’র সুব্রত ওরফে কাঞ্চন মৈত্র বলেছেন ” মুর্শিদাবাদের সমস্ত হেরিটেজ বিল্ডিং জেলাশাসকের মধ্যস্থতায় টেন্ডার করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে তৃণমূলীদের। কী করে এটা সম্ভব হয়?”
আর এসবের মাঝখানে ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে ফের প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলে ” আর কবে আর কবে বহরমপুর বিধানসভা তৃণমূল পাবে?” পুরসভার অলিন্দ আর হাতের তালু নাড়ুগোপালের কাছে অভিন্ন। তিনি জানেন কোথায় কে সিঁধ কাটতে পারে, কোথায় কে দূর্বল। আর সেই চেনা পথের প্রচারে গিয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছেন জন্ম কিংবা মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া থেকে আরও কত কত পরিষেবা দিতে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা কতটা দায়বদ্ধ। দাবি করছেন, আইন শৃঙ্খলার প্রশ্নেও জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলছে বহরমপুর। আর সে সবের পরেও পুরবাসীর মন টানছে বিরোধীরা। কেন?
তথ্য তুলে মানুষের কাছে তাঁর মরিয়া আবেদন, “২০২১ সালে এখানে বিজেপিকে জিতিয়েছেন, লোকসভায় কংগ্রেসেকে ৪৮ শতাংশ আর বিজেপিকে ৪০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। আমাদের কাজের ওপর ভরসা করে অন্তত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর ভরসা করে একবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের আরও কাজ করার সুযোগ দিন।” বলছেন, ” যাঁদের আপনারা আপনাদের প্রতিনিধি করেছেন সেই বিজেপি নেতাদের আপনাদেরই অভাব অভিযোগ শোনার মানসিকতাই নেই। তবু ওদের ভোট দিচ্ছেন কেন?”
সে কথা শোনার পর পুরবাসীর মত, ধর্মীয় মেরুকরণে ভাগ হয়েছে ভোট বাক্স। তার ফল পেয়েছে বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের ফল নিয়েও পুরবাসী তো বটেই শাসক দলের একাংশেরও উপলব্ধি ” ঘরের ছেলের থেকে পরের ছেলে কখনও আপন হয়। দেখলেন তো ঘরের ছেলেকে হারিয়ে পরের ছেলেকে দিল্লিতে পাঠিয়েছে সেই বহরমপুরবাসীই। অথচ দিনান্তে কেন এখন আবার মাসান্তেও তাঁর দর্শন পায় না কেউ।” সে কথা কী চেয়ারম্যান শুনছেন?