আজও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার মানুষের, যক্ষের ভাণ্ডার রাজার

Social Share
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে

বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ একটা যুদ্ধ কেন হয়? কী থাকে যুদ্ধে? কারা জেতে যুদ্ধে? পরাজয় কাদের?  যুদ্ধ নিয়ে এই ধরনের কথা হরবখত আলোচিত হয় সর্বত্র। তবু এক শ্রেণির মানুষ যুদ্ধ চায়, যুদ্ধ বাঁধায়। সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধই হোক আর এই অবেলায় ঘটে যাওয়া ইজরায়েল-গাজার যুদ্ধ কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধই হোক। বাদের তালিকায় নাম রাখা দায় ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের পরিস্থিতিকেও। তার উত্তর দিয়েছেন বিশ্বকবি। তিনি লিখেছেন, “স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে/ ঘটেছে সংগ্রাম।” কে না জানে পুঁজি চায় মুনাফা, আর তার জন্য মানবও যন্ত্র হয়।

বহরমপুরের ছান্দিক নাট্য সংস্থা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সদস্য প্রয়াত শক্তিনাথ ভট্টাচার্যের স্মরণে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে আসছে তাঁর মৃত্যুর পর। সেই বক্তৃতায় এবারের বিষয়বস্তু ছিল রক্তকরবী। একশো বছর আগে ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই নাটকটি। একদিকে যুদ্ধোন্মত্ত বিশ্ব অন্যদিকে রক্তকরবী প্রকাশের ১০১ তম বছরেও তা সমান প্রাসঙ্গিক, এই দুটি বিষয়কেই অলিখিতভাবে দর্শকদের সামনে হাজির করেছে ছান্দিক। আর তারজন্য বক্তা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত সেই স্মারক বক্তৃতার শিরোনাম ছিল “রক্তকরবী আশমান-জমীন”। এদিন তাঁর শিক্ষক সুলভ বক্তব্য বহুদিন স্মরণে থাকবে বহরমপুরের নাট্যমোদি দর্শকদের।

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় চলতি বছর ৮৫ বছর বয়সে পা দেবেন। এইদিন সন্ধ্যায় তিনি জানান “ আমার ৮০ বছর বয়সে আমি পুনরায় রক্তকরবী পড়তে শুরু করি।” আর তা পড়তে পড়তে তিনি নতুনভাবে এই নাটকটিকে দেখতে থাকেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেঁধেছিল মূলত শক্তিশালী দেশগুলির সাম্রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছেতে। ১৯৩৯ সালে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিশ্বযুদ্ধ। এই দুই যুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ে রচিত হয় রক্তকরবী। নাটক লেখার সময় রবীন্দ্রনাথের মনে এক যুদ্ধের সমাপ্তি ও আর এক আসন্ন বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল বলে মনে করেন এই গবেষক ও থিয়েটার,চলচ্চিত্রের সমালোচক। এই নাটক নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। নানান সময়ে চুলচেরা বিশ্নেষণ হয় নাটকটি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই নাটকটি নিয়ে বহুবার কাটাছেঁড়া করেছেন। নাটকটির বারোটি পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। বারবার বদলে যায় বইয়ের প্রচ্ছদও।

১৯২৪ সালে (১৩৩১ সালের আশ্বীন) যখন প্রথম প্রকাশিত হয় রক্তকরবী, সেই গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ছবিতে জার্মান চিত্রশিল্পী গ্রেয়গ গ্রস বা জর্জ গ্রস (Georg Grosz) এর আঁকা Metropolis ছবির প্রভাব স্পষ্ট। দুটি ছবি দেখিয়ে শমীক বাবু দাবি করেন দুটি ছবিরই এক শৈলী। তিনি বলেন, “ ওই আকাশচুম্বী বাড়ি আর তার আলোকিত জানালা। বাড়িগুলিকে ঘিরে একটি জাল। যক্ষ্মপুরীর রাজপ্রাসাদের জাল আবরণ। ওই রাজপ্রাসাদ সদম্ভ আকাশচুম্বী বাড়ি। আর তাকে অগ্রাহ্য করে যেন ফুটে ওঠে লাল রক্তকরবী।” যা আরও স্পষ্ট হয় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা আরও একটি ছবিতে।

এদিন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রক্তকরবী বিষয়ক বক্তব্যে রচনার পটভূমি বোঝাতে তিনজন জার্মান চিত্রশিল্পী ও একজন ফরাসী চিত্রশিল্পীর আঁকা কয়েকটি কালজয়ী ছবি দেখান ও তার ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তাপে আর আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচে ছবির ভাষা পাল্টে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ সেই বদলে যাওয়া ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চাইছেন। আর চাইছেন বলেই গগনেন্দ্রনাথকে প্রচ্ছদ আঁকতে দিয়েছেন।” গ্রেয়গ গ্রস বা জর্জ গ্রস (Georg Grosz) এর আঁকা সুইসাইড ছবিও ছিল সেই তালিকায়। সেনা না হয়েও এই চিত্রশিল্পীও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সেনা হিসেবে। যুদ্ধে অংশ নেওয়া আর এক শিল্পী অটো ডিক্স-এর Self-Portrait as a Soldier ছবি ছাড়াও বেশ কয়েকটি ছবি ছিল এদিন এই গবেষকের আলোচনায়। আলোচনায় ছিলেন আর এক জামার্ন মহিলা চিত্রশিল্পী কেথে কোলউইৎজ (Käthe Kollwitz) আর পিকাসো আর তাঁদের বিখ্যাত প্রাসঙ্গিক ছবি। যা এদিনের অনুষ্ঠানে অন্যতম প্রাপ্তি।

এদিন বর্ষীয়ান এই গবেষক- সামালোচক রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে মিলিয়ে দেন বর্তমান ভারতের শাসন ব্যবস্থাকেও। তিনি বলেন, “নাটকে রাজাকে আবদ্ধ করে রেখে ব্যবস্থা চালায় সর্দাররা। রাজাকে রাজার মর্যাদা দেওয়া হলেও ক্ষমতা দেওয়া হয় না রক্তকরবীতে। রাজা প্রশাসনের হাতে ক্রীড়নক মাত্র। তেমনি আমাদের দেশেও বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালামকে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা দেওয়া হয় কিন্তু তার কোনও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “লক্ষ্মীর ভাণ্ডার মানুষের হাতে আসে, যক্ষের ভাণ্ডার পুঁজি হয়, জমানো হয়, তাঁকে লগ্নি করে লাভ তোলা হয়।”

ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ প্রসঙ্গ টেনে এদিন শমীক বলেন, “গত কিছুদিনে দেখেছেন আমরা কত যুদ্ধশক্তি আয়ত্ত করেছি। আর সেই যুদ্ধশক্তি কত দ্রুত খাটানো যেতে পারে তারজন্য রোজ সৈন্যবাহিনীকে সম্মান দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী উর্দি পরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাচ্ছেন। আর গত কয়েকদিনে কতজন মানুষ যুদ্ধে নিহত হলেন তার হিসেবটা আমাদের সরকার এখনও আমাদের দেয়নি। তাই রক্তকরবী আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।” আয়োজক সংস্থার সম্পাদক বিশ্বনাথ রায় বলেন, “জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেই আমরা রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিই। বর্তমান পরিস্থিতিতেও তিনিই বল ভরসা। যুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোনও উপকার হয় না। উপকার হয় ব্যবসাদারদের। সেই কথাই প্রাঞ্জলভাবে এদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন শমীক বাবু তাঁর আলোচনায়। আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি।” শুধু নন্দিনী কোথাও নেই ” মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়। মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের যেখানে রূপের নৃত্য যেখানে প্রেমের লীলা নন্দিনী সেই সহজ-সুখের সেই সহজ সৌন্দর্যের।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights