
সন্দীপন মজুমদারঃ চলচ্চিত্রচর্চা আয়োজিত ছোট্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিন দেখানো হল তিনটি ছবি । সকালে দেখানো হল জাপানী পরিচালক কেনজি মিজোগুচির ছবি Sansho the bailiff (1954) বেলা এগারোটায়। বিকালে দেখানো হল মালয়ালাম ছবি ‘ Donkey in a Brahmin village’ (1977), পরিচালনায় ‘আম্মা আরিয়ান ‘ খ্যাত জন অ্যাব্রাহাম। সন্ধ্যে সাতটায় প্রদর্শিত হল Leos Carax পরিচালিত Holy Motors (2012) । মিজোগুচির ধ্রুপদী ছবিটির একটি ভালো প্রিন্ট ইউটিউবে আছে। কিন্তু লিওস কারাক্সের ছবিটি দেখার সুযোগ পাওয়া দুর্লভ। একেই তিনি খুব কম ছবি করেন। অন্তত এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার এক যুগ পড়ে যে এটি বড় পর্দায় দেখার সুযোগ হল তাতে আমি এতটাই অভিভূত যে শুধু এই ছবিটি নিয়েই দু-চার কথা বলতে চাই।
হোলি মোটরস বাস্তবতা অতিক্রমণকারী ছবি। স্যুররিয়েলিস্ট এবং সাই ফাই ঘরানার অনুসারী হলেও এই ছবিকে কোনো ঘরানায় বেঁধে রাখা যায় না। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি প্রমাণ করছে যে বিশ্ব সিনেমার নিরীক্ষাশীল ঐতিহ্য এখনও শেষ হয়ে যায় নি।ছবির প্রথমেই আমরা দেখি পরিচালক নিজেই তার শয়নকক্ষে মাঝরাতে উঠে একটা দেয়ালে একটা দরজা আবিষ্কার করন যেটা খুলে তিনি পৌঁছোন একটা অপেরা হাউজে যেখানে হল ভর্তি শ্রোতা যেন স্ট্যাচুর মত শিলায়িত। সেখানে অলিন্দে নগ্ন শিশু এবং বিরাট কুকুর ঘুরে বেড়ায় । কারাক্স পরে এক সাক্ষাৎকারে যে কোনো শিল্পের ভূমিকা হিসেবে কাফকার এই লাইনটি উদ্ধৃত করেন – আমার অ্যাপার্টমেন্টে একটি দরজা আছে যেটা আমি আগে লক্ষ্য করিনি।
গোটা ছবি জুড়ে পারি শহরের রাস্তায় ( যে রাস্তা রহস্যময়, সুন্দর , কখনও ডিজিটালি পুনর্নির্মিত) একটি বিরাট লিমুজিন গাড়িতে চেপে অসকার (Denis Lavant) নামে একটি মধ্যবয়স্ক চরিত্রের পরিভ্রমণ এবং সারাদিন ধরে গাড়ি থেকে নেমে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়। তার গাড়ির বৃদ্ধা চালক সেলিন ( Edith Scob) তাকে জানিয়ে দেয় যে তাঁর নটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে সারা দিনে। অতিবৃদ্ধা জিপসী ভিক্ষুক, হিংস্র রাক্ষুসে এক অন্ত্যেবাসী থেকে ঘাতক পর্যন্ত। ঘাতক যখন সে অবিকল নিজের মত দেখতে একজনকে খুন করে।
আবার কখনো সে রাগী, বিরক্ত এক পিতা যে আদরের কন্যাকে পার্টি থেকে নিয়ে আসে। এক সময় সে গোটা গায়ে সেনসর লাগানো এক ডিজিটাল অ্যাক্রোব্যাট যে একটি অনুরূপ সেমি ডিজিটাল সর্প সদৃশ নারীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের সিম্যুলেসন করে। আবার এক সময় সে এক শয্যাগত অতিবৃদ্ধ মুমূর্ষু যার শেষ সময়ে তাঁর প্রিয় ভাইঝির সঙ্গে মৃত্যু এবং প্রেম নিয়ে কিছু দার্শনিক কথাবার্তা হয়। যদিও এটা দুজনেরই রোল প্লেয়িং। কারণ ঐ ভাইঝির ভূমিকায় থাকা মেয়েটিও জানায় যে তারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আরও। শেষ অ্যাপয়েন্টমেন্টে অসকার বাড়ি ফেরে যখন তাকে গ্রহণ করে একটি পূর্ণবয়স্ক এবং একটি বাচ্চা শিম্পাঞ্জি।
শেষ দৃশ্যে সেলিন যখন হোলি মোটরস নামক বিরাট গ্যারেজে লিমুজিনটি পার্ক করে বেরিয়ে আসে দেখা যায় সেখানে আরও অনেক লিমুজিন এনে পার্ক করা হচ্ছে। নির্জন গ্যারেজে গাড়িগুলি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। মনে রাখতে হবে অসকারের এই নটি ভূমিকায় অভিনয়ের সময় প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা মেকআপ করতে দেখালেও (যে ব্যবস্থা গাড়ির মধ্যেই আছে) কখনও তার অভিনয় রেকর্ড করতে কোনো ক্যামেরা দেখানো হয় নি।
কারাক্স বলছেন যে এই গাড়িটি অসকারকে বিভিন্ন জীবনের মধ্যে দিয়ে তার জার্নিটা করাচ্ছে। এখানে মানুষ, যন্ত্র ( যেগুলো বাতিলের মুখে এবং ঢাউস আকারের) এবং পশু একজোট হয়ে হয়ে ডিজিটাইজেশনের যুগে নিজেদের অবলুপ্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ডিজিটাইটেশন মানে ভৌত উপস্থিতির ক্ষয়, নেটওয়ার্কের জগৎ। এর বিরুদ্ধে কারাক্স তার অপছন্দের কথা বলেন । কিন্তু যেভাবে বলেন তাতে শিল্পের অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলে যায়।
কারাক্স সাহসের কথা বলেন, সাহস কমে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেন, বাচ্চাদের সাহসী হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন। একটা ওপেন সেশনে একজন শ্রোতা তাঁকে প্রশ্ন করেন, এই সাহস বলতে তিনি কী বলতে চাইছেন।কারাক্স তখন বলেন নিজের গল্পটা বলতে পারার সাহসের কথাই তিনি বলছেন। শুনে মনে হতে পারে এ বুঝি খুব সহজ কথা। কিন্তু নিজের বিশ্বাস খুঁজে নিয়ে ( ওই ওপেন সেশনেই কারাক্স বলছেন বিশ্বাস ছাড়া সিনেমা করা যায় না ) ,নিজের জগতটা খুঁজে নিয়ে নিজের গল্প বলে ওঠা কঠিন। কত যে ভয় আমাদের সেই সত্যদর্শন থেকে বিরত রাখে !

লেখক একজন নাট্যকার, সমালোচক, চিন্তক, সুবক্তাও। একজন নিবিড় পাঠক শুধু নন সন্দীপন মজুমদারের খ্যাতি তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণেও। জেলা তথা রাজ্যে সাড়া ফেলা ‘সিনেমা ভাবনা’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদকও তিনি।