প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে রাখাই ভবিতব্য

Social Share

সন্দীপন মজুমদার, বহরমপুরঃ বিখ্যাত চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা লিখেছিলেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়াই। গত ৯ই অগস্ট আরজিকর হাসপাতালে তিলোত্তমার নৃশংস খুন আর ধর্ষণ কাণ্ডের অব্যবহিত পর থেকেই তাই এ রাজ্যের ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু হয় সব ভুলিয়ে দেওয়ার আয়োজন। উৎসবে ফেরার  আবেদনের অন্তরালে বাধ্যতামূলক বিস্মৃতির ফতোয়া। আসলে শাসক জানে যে যতদিন এই ক্ষমাহীন অপরাধের স্মৃতি আমাদের পীড়িত করবে ততদিন সে স্বস্তি পাবে না।  বিচারের দাবি শুধু আদালতের চৌকাঠে ঘুরে না মরে যতই সামগ্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করবে ততই  শাসক অসহিষ্ণু হবে, কারণ সে জানে এই পাপের দায়ভাগ সবচেয়ে বেশি তার।

তাই তিলোত্তমার নৃশংস হত্যার স্মৃতিকে  ভুলতে না দেবার অঙ্গীকার থেকে  গত  ৬ই অক্টোবর ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠী বহরমপুর গ্র্যান্ট হলের মাঠে যে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল তার গুরুত্ব অপরিসীম। শেষ পর্যন্ত এই  ঘটনার বিচারের দাবি শুধু আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে থাকলে চলবে না– ধর্ষণ ,হুমকি ও দুর্নীতির যে অপসংস্কৃতি, তার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী লড়াই চালাতে হবে। এটাই সময়ের দাবি । তাই এই অনুষ্ঠানে ঋত্বিকের নির্মাণে এবং বিপ্লব দের প্রয়োগে ‘ ঘটনার অন্তরালে’ নামক খোলা মঞ্চের নাট্য প্রযোজনা একদম যথাযথভাবে একটি  প্রতিবাদী আয়ুধের কাজ করে।

এত সমসাময়িক ঘটনার সারাৎসার এত অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে সনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ এবং তার শৈল্পিক উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শকের আবেগের  তন্ত্রীকে ছুঁতে পারে তার নিদর্শন হয়ে থাকল এই প্রযোজনাটি। আশ্চর্যের এটাই যে এতগুলি তথ্য এবং সংবাদকে ধারণ করে এই প্রযোজনা নেহাৎ বিবরণধর্মী হয়ে থাকে নি, উপযুক্ত থিয়েটারের ভাষাকে খুঁজে নিয়েছে।  আবহ, পোষাক ও সঙ্গীত পরিবেশনের নৈপুণ্যে হয়ে উঠেছে  তিলোত্তমার স্মৃতির প্রতি একটি সার্থক সাংস্কৃতিক  শ্রদ্ধার্ঘ্য। অভিনয়ের দিক থেকে ঋত্বিকের সুনিপুণ টিমওয়ার্ক নাটকের ছন্দপতন হতে দেয় নি কোথাও।

ব্রীহি সাংস্কৃতিক সংস্থা মুক্তমঞ্চের নাটক ‘যারা উজানে’-র একটি দৃশ্য।

একই অনুষ্ঠানে বহরমপুরের ব্রীহি সাংস্কৃতিক সংস্থা মুক্তমঞ্চের নাটক ‘যারা উজানে’ উপস্থাপিত করেন। এখানে সব অভিনেতারাই ছিলেন নারী। বক্তব্যের বিষয়ও সমাজে নারীর ওপর আক্রমণ, অবদমন এবং প্রতিরোধ। তিলোত্তমা কাণ্ডের ছায়া, দিল্লীর মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থার ঘটনা ,হাথরাসের ধর্ষণ—এই সমস্ত প্রসঙ্গই এসেছে। কিন্তু প্রসঙ্গের ব্যাপ্তি থাকাটা নাটকের ঘনপিনদ্ধ মেজাজকে কিছুটা ক্ষুণ্ণ করেছে মনে হয়। নাট্যনির্মাণে এবং সংলাপেও আরেকটু অপ্রত্যক্ষতা নাটকের অভিঘাতকে  তীব্রতর করতে পারত বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে। কলাকুশলীদের আবেগী উদ্গীরণে তাদের আন্তরিক নিষ্ঠার পরিচয় অবশ্য পাওয়া যাচ্ছিল।

সব মিলিয়ে ঋত্বিকের এই অনুষ্ঠান প্রতিবাদী গান, আলোচনা এবং নাটকের উপস্থাপনে এবং মাঠভর্তি দর্শকের সপ্রাণ উপস্থিতিতে প্রমাণ করল তিলোত্তমার স্মৃতিকে পাথেয় করে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে রাখাই এই সময়ে আমাদের  অনিবার্য ভবিতব্য । মর্মার্থ এটাই, আমরা এই দুরপনেয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কলংকের চিহ্নকে মুছে ফেলার  প্রয়াসে অংশীদার হতে অস্বীকার করি যতদিন না তার কারণগুলির উৎপাটনে বিচারের বাণী, বৃহত্তর অর্থে, পূর্ণতা পায়।

আরও পড়ুনঃ কমছে ভাল লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যাও

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights