
বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ বিশ বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন বাংলা চলচিত্রের অভিনেতা ও পরিচালক সুখেন দাস। একটি পরিবারের সুখ দুঃখের ছবি উঠে আসত তাঁর নির্মিত ছবিতে। বড়লোক বাড়ি থেকে সংসারের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফুটপাতের বাসিন্দা হয়ে ফের সেই প্রাসাদ জয়ের মধ্যে মধ্যবিত্তের ম্যাটিনি শো জুড়ে থাকত সত্যের জয়, মিথ্যের পরাজয়। আর সবশেষে পারিবারিক বন্ধনের ছবি। নয়ের দশকে সেই ছবি হলে দেখে একাংশ দর্শক চোখের জল ফেলতে ফেলতে বেড়িয়ে আসতেন। সেই ছবির রেশ হয়ত তাঁদের কাছে থেকে যেত অনেকক্ষণ। বাংলা সিনেমা, দর্শক ও সিনেমা হলও বদলে গিয়েছে আজ।
বদলে যাওয়া মাল্টিপেক্সে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বহুরূপী দেখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই সুখেনকে। ‘বহুরূপী’তেও আছে পরিবার, আত্মজনের কথা। আছে যে ভাইকে একসময় ষড়যন্ত্র করে গরাদে পাঠিয়েছিল যে দাদা, তাঁর মৃত্যুর পর সেই দাদার স্ত্রী-পুত্রকে সেই ভাইয়ের কাছেই ফিরতে হয় সাহায্যের দাবি নিয়ে। এই ছবিতে বিক্রম প্রামাণিকের চেহারার সঙ্গে সুখেন দাসের সেই খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালির ছাপ যেন স্পষ্ট। সেই চরিত্র, যে জুট মিলের শ্রমিকদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মিটিং, মিছিল করে।

শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে। সেই নেতা, সেই ছেলেটাই বিক্রম। কিন্তু ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতা দুনিয়ায় মিথ্যে মামলায় ফেঁসে যাওয়া সেই ছেলেটা অপরাধ জগতেই শেষ পর্যন্ত নাম লেখায় স্বেচ্ছায়। আর শেষে পুলিশ আধিকারিক সুমন্ত ঘোষাল (আবীর চট্টোপাধ্যায়)-এর মতো সৎ,আদর্শবাদী পুলিশ আধিকারিককে ঘোল খাইয়ে যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলে ‘বহুরূপী’ বিক্রম। জয় হয় সততার। স্থায়ী হয় কর্মফলের নীতি বাক্য। তবে এই সিনেমা নির্মিত হয়েছে বাস্তব এক চরিত্রের উপর নির্ভর করে। প্রথম সিন থেকে শেষ সিন পর্যন্ত পর্দা থেকে চোখ সরানোর অবকাশ নেই দর্শকের। তারমধ্যেই বিক্রম প্রতিবাদ করে বহুরূপী শিল্পীদের অমর্যাদার জন্য, তাদেরকে কাজে লাগালেও অবহেলাই তাদের ভবিতব্য অথচ সরকারের দায় ছিল তাদের দায়িত্ব নেওয়ার। যা আরও একটি দিক সমাজকে ভাবতে বাধ্য করবে। চাইলে প্রশাসনও ভাবতে পারে। তবে একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই সুখেন দাস পরিচালিত ছবির সঙ্গে শিবু-নন্দিতা পরিচালিত ছবির তুলনা হয় না। ডিজিটাল দুনিয়ায় একটা ফোন নম্বর দেখে এক চুটকিতে জেনে নেওয়া যায় লোকেশন। তবু পুলিশ সে দিকে যায় না। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের বাড়বাড়ন্তও দেখানো যেত ছবিতে। বিশেষ করে ছ্যাচড়ার ঝিমলির পক্ষে ফেসবুক ব্যবহার করা স্বাভাবিক। সন্তর্পণে সেই পথ এড়িয়ে গিয়েছেন পরিচালক।

অভিনয়ে আবীর, শিবুকে একশো দেওয়াও কম মনে হয়। ঋতাভরী চক্রবর্তীর তুলনায় কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় ভাল লাগলেও কথা বলবার ধরন বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়েছে। যা আরোপিত মনে হয়। বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য ‘কড়া পাকের মিষ্টি’। পুরো সিনেমা জুড়ে তাঁর অবস্থান। কিন্তু তাঁর অননুকরণীয় অভিনয় তাঁকে এবারও তাঁর অভিনিত অন্য চরিত্র থেকে পৃথক করেছে।
তবে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে দর্শককে হলে আনার চেষ্টা করা হলেও বহরমপুরে মোহন হলে প্রথম দিনের প্রথম শো’য়ে দর্শক ছিল হাতে গোনা। প্রশ্ন ওঠে এই ছবিও কি শহরেই আটকে থাকবে। শপিং মল ঘোরা মানুষজনের মুখেই ঘুরবে বিক্রমদের কথা ? পুজোতে রিলিজ হওয়া শিল্পের সব দিক বজায় রাখা একটি সিনেমা কী বাজার ধরতে গ্রামে নামবে না? আর তা না হলে ২০২৪-এর শেষ লগ্নে দাঁড়িয়েও গ্ল্যামারের সব আলোটুকু শুষে নেওয়া নন্দিতা-শিবুকে বলে বলে দশ গোল দেবেন ট্র্যাজিক পরিচালক সুখেন দাস।