
সন্দীপন মজুমদারঃ চলচ্চিত্র চর্চার উদ্যোগে বহরমপুর কালেক্টরেট ক্লাব অডিটোরিয়ামে ছোট্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে গত ৭ই এবং ৮ই মার্চ তৃতীয় এবং চতুর্থ তথা শেষ দিনে দেখানো হল আরও ছয়টি ছবি।
তৃতীয় দিন সকাল এগারোটায় দেখানো হল লুই বুনুয়েল পরিচালিত ‘ The Criminal Life of Archibaldo De La Cruz (1955)। বুনুয়েল এটি নির্মাণ করেন মেক্সিকোতে। এটি একটি অদ্ভূত ঘরানার সিনেমা যাকে অনেকে ক্রাইম কমেডি বলেছেন। এখানে প্রধান চরিত্র ধনী আর্কিবাল্ডো অনেকটা সিরিয়াল কিলারের মতই বিভিন্ন চরিত্রকে খুন করার কথা ভাবে কিন্তু বাস্তবে একটি খুনও করা হয় না তার। ঘটনাচক্রে তার সম্ভাব্য ভিকটিমরা ঠিক আগে বা পরে অন্যভাবে মারা যায়।
বুনুয়েলের অন্য ছবির মত তীব্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী বা ধর্মের সমালোচনা না থাকলেও উপভোগ্যতার মাত্রায় আজকের দিনে নির্মিত যে কোনো টানটান চিত্রনাট্যের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দেবে এই ছবি।
ঐ দিন বিকেল চারটেয় দেখানো হয় কুমার সাহানীর ছবি ‘ খেয়াল গাথা ‘। সাহানীর অন্য ছবির মতই এই ছবিও নিরীক্ষাশীল। ব্রেসোঁর ভক্ত হিসেবে তিনি সেইরকম আবেগবর্জিত অভিনয় করান শিল্পীদের দিয়ে । কিন্তু ব্রেসোঁর ছবির ন্যারেটিভ অনেক বেশি গতিশীল থাকত। সেখানে সাহানীর ছবি দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। তারই মাঝে কোনো কোনো ফ্রেমিং এবং কম্পোজিশন অবশ্য মুগ্ধ করে ।
সন্ধ্যে সাতটায় দেখানো হয় তুরস্কের পরিচালক নুরি বিলজে সেলানের কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’অর পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘ Winter Sleep’ ( 2014), ছবির দৈর্ঘ্য তিন ঘন্টা ষোল মিনিট। সেলান ধীর লয়ে তাঁর ন্যারেটিভকে বাঁধেন। ছবির বিষয়বস্তুও হয় মানূষের সম্পর্কের সূক্ষ্ম গভীরতা, প্রকৃতির পরিপূরক সম্পর্ক , অনুচ্চ সংলাপ। যাঁরা ছবি দেখেন গভীর অনুভবের বোধে স্নাত হওয়ার জন্য এই ছবি তাঁদের অবশ্যই ভালো লাগবে।
চতুর্থ তথা শেষ দিন সকাল এগারোটায় দেখানো হয় ঋত্বিক ঘটকের বহুল আলোচিত ছবি অযান্ত্রিক ( ১৯৫৮)। বিকেল চারটেয় দেখানো হয় সৈদ আখতার মির্জার ছবি ‘ নাসিম ‘। ১৯৯২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আগের কয়েক মাসের পটভূমিকায় একটি মুসলিম পরিবার,একটি কিশোরী মেয়ে নাসিম , তার শযাগত অতিবৃদ্ধ পিতামহ এবং পরিবারের অন্য সদস্য ও প্রতিবেশীদের নিয়ে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছবি। মসজিদ ভাঙ্গার বর্বরতার সামনে দাঁড়িয়ে এ ছবি মৃদুকণ্ঠ প্রতিবাদে মানুষের শেকড়ের কথা বলে, ভোরের বাতাসের নির্মলতার কথা বলে (নাসিম মানেই তাই), সব পরিস্থিতিতে হেসে ওঠার মত মন বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ছত্রছায়া ছাড়াই একদল তরুণ চলচ্চিত্রচর্চার প্রসারের স্বপ্ন দেখে বহরমপুরে পত্রিকা প্রকাশ, চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করেছিলেন।
উৎসবের সর্বশেষ ছবি ২০১৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কারপ্রাপ্ত রাশিয়ান ছবি Andrey Zvyagintsev পরিচালিত ছবি ‘ Leviathan’। এই ছবি দেশের বাইরে অনেক পুরস্কার পেলেও দেশের অভ্যন্তরে অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছে। রাশিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী এই ছবির সমালোচনা করে বলেছেন যে এই ছবিতে রাশিয়ানদের খুব খারাপ ভাবে দেখানো হয়েছে। আসলে এই ছবিতে পরিচালক পুতিনের রাশিয়ায় ক্ষমতাবানদের যে দুর্নীতিতন্ত্র চলছে তাকে খোলাখুলি দেখিয়েছেন। পাশাপাশি এর সঙ্গে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের যোগসাজস ও তাদের দ্বিচারিতা, সাধারণ মানুষের অসহায় এবং ব্যর্থ লড়াই – সুনিপুণ চিত্রনাট্য, ক্যামেরা ও অভিনয়ের মাধ্যমে দেখিয়েছেন। দেখতে দেখতে অবশ্য সব দেশেরই সাধারণ মানুষ এর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করবেন।
চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হল বটে কিন্তু একটা বার্তা দিয়ে গেল। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ছত্রছায়া ছাড়াই একদল তরুণ চলচ্চিত্রচর্চার প্রসারের স্বপ্ন দেখে বহরমপুরে পত্রিকা প্রকাশ, চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করেছিলেন। এই প্রজন্মের কিছু তরুণ তরুণী সেই কাজটা অনেক স্থৈর্যের সঙ্গে আবার শুরু করেছেন। না, ফিল্ম আন্দোলন করে সমাজটাকে পালটে দেবেন সেরকম স্বপ্ন তাঁরা দেখেন না।
আপাতভাবে এখন শুধু ফিল্ম নয়, বইপত্র থেকে অন্যান্য সাংস্কৃতিক উৎপাদন — ডিজিটাল প্রাপ্তিযোগ্যতা বেড়েছে সবকিছুর। অথচ যে কোনো সমবেত উদ্যোগ যেখানে মানুষে মানুষে ভাব বিনিময়ের সুযোগ থাকে , তা আজ বড় চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েছে। সমাজমাধ্যম থেকে মাল্টিপ্লেক্স— চিন্তাহীনতার রাজনীতি হয়ে উঠছে অসীম শক্তিধর দৈত্যাকার লেভিয়াথান।
ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস তাঁর ১৬৫১ সালে লেখা বইতে লেভিয়াথান নামে যে অসীম ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় শক্তির কল্পনা করেছিলেন ঠিক তেমনটা হয়, বরং বহুব্যপ্ত হয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে মুনাফা আর পুঁজির কেন্দ্রীভূত শক্তির লেভিয়াথান নিজেকে ব্যপ্ত করেছে। এর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রক্তাক্ত হলেও লড়াটাই মানুষের নিয়তি। কারণ টমাস হবস বলেছিলেন মানুষ আক্রান্ত হলে নিজেকে বাঁচাতে চায়, সেলফ প্রিজার্ভেশন তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। প্রজাতিগত ভাবে মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্ক, তার স্ব-ভাব, তার পরিবেশ আজ অধিকৃত আর আক্রান্ত। তাই পাহাড়প্রমাণ প্রতিকূলতা, যা যত না বিরুদ্ধতা তার চেয়ে অনেক বেশি ঔদাসীন্য আর উপেক্ষার হাত ধরে আসে –তার বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম চালু রাখাটাই গুরুত্বপুর্ণ । চলচ্চিত্রচর্চা এই ফিল্ম ফেসটিভ্যাল আয়োজন করে সেকথা বুঝিয়ে দিল।

লেখক একজন নাট্যকার, সমালোচক, চিন্তক, সুবক্তাও। একজন নিবিড় পাঠক শুধু নন সন্দীপন মজুমদারের খ্যাতি তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণেও। জেলা তথা রাজ্যে সাড়া ফেলা ‘সিনেমা ভাবনা’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদকও তিনি।