
সংবাদ হাজারদুয়ারি ওয়েবডেস্কঃ চারঘন্টা পুলিশ আসেনি, কিন্তু এখন পুলিশকে ডাকলে তারা আপনার ঘরে পৌঁছে যাবে পরিষেবা দিতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বিএসএফ নয়, রাজ্য পুলিশের ক্যাম্প বসানো হল বেতবোনায়। দায়িত্ব নিয়ে নয়া আধিকারিকরা এমনই বরাভয় দিলেন গ্রামবাসীদের।
সংশোধনী ওয়াকফ আইনকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়িয়েছিল এই বেতবোনা, পাশের জাফরাবাদ সহ তিন পাকুড়িয়া পঞ্চায়েত জুড়ে। সেখানে বেতবোনায় সাব ইন্সপেক্টর মিঠুন হালদারকে ক্যাম্পের ভার দিয়ে শমসেরগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক সুব্রত ঘোষ জানান, “ আপনাদের সুবিধা অসুবিধা উনিই দেখবেন।” এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “ পুলিশ আপনাদের সঙ্গে আছে। যখন যে অসুবিধা হবে জানালে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাবে। আপনাদের ঘরে পুলিশ পৌঁছে যাবে।”
একটা গ্রামে একটা পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে গ্রামকে আইনের শাসনে বাঁধতে চাইছে রাজ্য। ২০২৫- যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা দূরকে নিকটে এনে দুনিয়াকে মুঠোয় বন্দি করেছে, তখন একটি গ্রামের মানুষের ভয় ভাঙাতে ২৭ জন পুলিশের একটি দল সঙ্গে বিএসএফের জওয়ানরা কোমর বেঁধেছেন। বাইরের শত্রুরা যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। এও এক যুদ্ধের প্রস্তুতি?
ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারের দাবিকে কেন্দ্র করে যখন বল্গাহীন হিংসা ছড়িয়েছিল এই অঞ্চলে, তখন যদি খবর পেয়ে ছুটে আসত পুলিশ তাহলে এত কিছুর প্রয়োজন হত না। বেলাগাম ক্ষয়ক্ষতি হত না। পুলিশ সেই সুযোগ দিয়েছে, বলছেন এলাকার মানুষজনই। চারঘন্টা পুলিশ আসেনি, সেই ক্ষোভ এখনও ধিক ধিক জ্বলছে। যদিও পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “ পুলিশ আছে কোথায়? সবই তো সিভিক ভলান্টিয়ার? না আছে অস্ত্রের ব্যবহার, না আছে আইনের শাসন? আমাদের এগোলেও বিপদ, পিছোলেও বিপদ।”
তবে মুখ্যমন্ত্রী জেলায় পা দিয়েই টের পেয়েছেন উত্তরে পুলিশের আলগা মনোভাবেই দাবানল দেখেছে বাংলা। পুলিশের গোপন সূত্র নেই। থাকলে জাফরাবাদের নিহত বাবা ছেলেকে বিরোধীরা গোপনে এলাকা ছাড়াতে পারত না। তার জবাবদিহি করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বকুনিও খেতে হয়েছে রাজ্য পুলিশের ডিজিকে, এই মুর্শিদাবাদে গত তিনদিনেই।
পুলিশের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব ঘোচাতে পুলিশকে মেলায় খেলায় পাঠিয়ে জনসংযোগের বার্তা দিয়ে আইনকে বন্ধুত্বে বাঁধতে চেয়েছিল তৃণমূল সরকার। ২০১১ থেকে ২০২৫। গত ১৪ বছরে বাংলার মানুষ দেখেছে রাজ্যের ওই মানসিকতায় একটা বড় অংশের পুলিশ আর শাসকদলের নেতা এক হয়ে গিয়েছে বাংলায়। শাসকদলের শতাধিক গোষ্ঠীর কোনও এক বা একাধিক গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে পুলিশ নেতা হয়ে গিয়েছে। আর নেতার কাছে এক ফোনে পৌঁছে গিয়েছেন পুলিশের একতারা, দু-তারারা। মানুষ ভাগ হয়ে গিয়েছে। কেউ ভয় পেয়েছে, কেউ পেয়েছে আস্কারা।
এসডিও, বিডিওদের আজ ব্যাক অফিস জব। এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভারতের সংবিধানে, রাজ্যের প্রশাসনিক পরিকাঠামোয় তাদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সে কথা আজ আর কেউ ভাবেন না। আলস্যতা আছে সাধারণ প্রশাসনের একাংশেরও। অন্তত মুর্শিদাবাদের গ্রাম বাংলায় পা রাখলে তা টের পাবেন যে কোনও ভিনদেশি। বেতবোনায় মিষ্টি মুখ করিয়ে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হল ঠিকই কিন্তু সেখানেও সাধারণ প্রশাসনের কাউকেই দেখা গেল না ধারে কাছে।
গ্রামের পথে প্রান্তরে কান পাতলে আজও একটি গল্প শোনা যায়, আই এ এস পাশ করে গ্রামের এক যুবক গ্রামেরই এক প্রবীণকে প্রণাম করছেন। ওই প্রবীণ আশীর্বাদ করে বলছেন, “ এই জন্মে ডিএম হলে বাবা, পরের জন্মে ওসি হও এই কামনা করি।” পুলিশের ক্ষমতা এখানেই। সেই পুলিশকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন মমতা।
রাজ্যের মুখ্য সচিব এই মুর্শিদাবাদে অতিরিক্ত জেলাশাসকের পদ সামলেছেন, জেলাশাসকের পদ সামলেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে। বুধবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ যখন তিনি হরিহরপাড়ায় গেলেন বিশেষ অনুরোধে, তার আগের রাত্রে ওই থানার অন্তর্গত মালোপাড়ায় চলেছে গুলি, আহত একজন। পুলিশ দোষীদের গ্রেফতার করেছে। আহত ও আততায়ী উভয়েই তৃণমূলকর্মী। অনেকেই ভেবেছিলেন, “ জেলায় মুখ্যমন্ত্রী আছেন, তাই পরিস্থিতি দেখতে মুখ্যসচিব পৌঁছে গিয়েছেন অকুস্থলে।” যদিও জানা গেল মুখ্যসচিব কেন এলাকার বিডিওই জানতেন না গুলিগালার কথা। তিনি কিন্তু পদাধিকার বলে ব্লকের ম্যাজিস্ট্রেট।
সমন্বয় যে কোনও প্রতিষ্ঠানের শিরদাঁড়া, সে কথা আজ নতুন যেকোনও উদ্যোগপতিও জানেন, কিন্তু তা জানেন না প্রশাসনের মাথারা? মনোজ পন্থও টের পেয়েছেন গলদ রয়েছে গোড়ায়। সব দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বৈঠক করেছেন প্রশাসনিক ভবনে। টোকা দিয়ে বুঝে নিতে চেয়েছেন প্রশাসনের আসল চিত্র। মুখ্যমন্ত্রীর কানেও সে কথা পৌঁছেছে।
সূত্রের দাবি, পুলিশ যদি হিংসার ঘটনায় গোল্লা পায়, তা সামলে দিয়ে জেলাশাসক ও তার টিম পেয়েছে একশো। মাঠ ছাড়ার আগে মুর্শিদাবাদ পুলিশ জেলার সুপার কুমার সানি রাজকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আলোচনা করে কাজ করতে। ডিএমকে জানিয়ে কাজ করতে। হয়ত আবার জেলায় আসবেন তাড়াতাড়ি, তখন তিনি শুনতে চান না কোনও অজুহাত, তিনি চাইছেন শান্তি। ফেরাতে চাইছেন ব্র্যান্ড মমতা। ফিরবে কী? ফেরাতে পারেন সেই এসপি আর ডিএমরাই, বলছেন পোড় খাওয়া রাজ্য প্রশাসনের অন্য জেলার এক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারি।