
সংবাদ হাজারদুয়ারি ওয়েবডেস্কঃ মহাভারত শিখিয়েছে গুরুদক্ষিণার কথা। সেই ধারা মেনে শিক্ষককে আলাদা আসনে বসিয়ে কার্যত পুজো করতে শিখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বলা বাহুল্য, সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎশাস্ত্রের মতো জটিল বিদ্যার পড়াশোনায় কৃতকার্য হওয়া থেকে সোনার পদক পাওয়া এখন শিক্ষকের “বাঁয়ে হাত কা খেল” হয়ে যে দাঁড়িয়েছে তার হাতে গরম উদাহরণ আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
তবে তার ব্যতিক্রমও আছে। ১৯৯০ এর গোড়ায় বহরমপুরের এক তরুণ নিজের লেখাপড়ার মাঝখানেই বেছে নিয়েছিলেন গৃহ শিক্ষকতার কাজ। সেই শিক্ষক দেবজ্যোতি বিশ্বাস এ যাবৎ প্রায় হাজার চারেক পড়ুয়াকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির রসায়ন বিদ্যা পড়িয়েছেন। পড়ুয়া ও শিক্ষকের রসায়ন কেমন হওয়া উচিত তা হাতে কলমে পরীক্ষা করে তার প্রমাণও দিয়েছেন গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে। সুকুমার সেনের কথায়, পড়া দেওয়া আর পড়া নেওয়া এই দুয়ে মিলিয়ে পড়ানো। সময়ের স্রোতে পড়ুয়া ও শিক্ষকের সম্পর্কের রঙ বদলেছে ঠিকই কিন্তু দেবজ্যোতি বাবুর সেই কাজ নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই কোনও কৃতির। উল্টে তাঁরা মার্কশিটে যোগ করেছেন তাঁর পিতৃত্বের একাধিক নমুনা।
খাতায় কলমে রবিবার বাদ দিয়ে বছরভর পড়াশোনা হওয়ার কথা থাকলেও নানান কারণে পড়ার দিন সংখা কমে যায় স্কুলে। থেকে যায় পড়াশোনায় ঘাটতি। সেই ঘাটতি কাটিয়ে পরীক্ষায় কৃতি হতে প্রয়োজন একজন দায়িত্ববান গৃহশিক্ষকের। সেই ভরসা দেবজ্যোতি বাবু পড়ুয়া ও তার অভিভাবকদের বছরের পর বছর জুগিয়ে এসেছেন ধারাবাহিকভাবে, দাবি তাঁদেরই একাংশের। বিতর্ক , হাজারও নিষেধ সত্বেও সরকারি স্কুলের একাংশ শিক্ষকও গৃহশিক্ষকতা করেন। কিন্তু গৃহশিক্ষকতাই দেবজ্যোতির পেশা। লড়াইও তাই কঠিন। প্রসঙ্গত, সেই আয়ের করও দিতেন এই শিক্ষক।
বহরমপুর টাউন ক্লাবের উল্টোদিকের বাড়িটার কখনও দো-তলায়, কখনও এক তলায় পড়ুয়াদের সঙ্গে কাটানো সেই সব “নানা রঙের দিনগুলি”র কথা ফেসবুকে ধারাবাহিকভাবে বছরখানেক ধরে লিখেছেন তিনি। কালীপুজোর দিন বিকেলে দুই মলাটে বন্দি করে তারই এক টুকরো প্রকাশ করলেন হাটের মাঝে । কালেক্টরেট ক্লাবের অডিটোরিয়ামে তা উন্মোচন করলেন দেবজ্যোতি বাবুর শিক্ষক রসায়নের আরও এক প্রবাদ প্রতীম অধ্যাপক কামাখ্যা গুহ। দ্রোণাচার্য প্রকাশ্যে আনলেন সেই সব একলব্যদের কথা, যাঁরা গুরুদক্ষিণা হিসেবে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এও এক উল্টোপথে হাঁটা বৈ কি। কিন্তু কেন? দেবজ্যোতি বাবুর কথায়, “৫৫ বছর পার হয়ে এসে সামনের সময়টা যখন কমে আসছে তখনই পিছনের দিন গুলো তাকিয়ে দেখতে ভালো লাগে।”
কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতিকে অনুসরণ করে এগোচ্ছে রাজ্য। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল প্রথা উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষাকে অন্ধকারের দরজায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে বহু আগে। এখন একাদশ শ্রেণির সিলেবাসে পড়ার বোঝা বাড়িয়ে শিক্ষাকে নম্বরের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেবজ্যোতিবাবুর কথায়, “পাঁচ কেজি হাঁড়িতে দশ কেজি চাল রান্না করার মতো পরিস্থিতি হয়েছে।” বিজ্ঞানের পড়ুয়ারা হাতে কলমে খুঁটিনাটি না শিখেই মার্কশিটে আদায় করে নিতে শিখেছে পুরো নম্বর।
সরকারি স্কুলে ঢের বেড়েছে পড়ুয়ার সংখ্যা। তারসঙ্গে তাল মিলিয়ে কলেজে কলেজে আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তবুও ফি বছর ফাঁকাই থাকে কত আসন। কলেজ থেকে, পড়াশোনা থেকে মুখ ফেরাচ্ছে পড়ুয়ারা। গৃহশিক্ষকতার পেশাতেও টান পড়ছে। অনেকেই পড়তে আসে, না পড়ে চলে যায় তারও বেশি। আর সেই সব কিছু নিয়ে আক্ষেপ কম নেই শিক্ষককূলের একাংশের। আগাগোড়া বামপন্থী দেবজ্যোতি বাবুও বলছেন, ” পড়াশোনাটাই হারিয়ে যাচ্ছে। টিউশন অনেক পরের ব্যাপার।” তাঁর আরও দাবি, ” ইদানিং সিলেবাস, পরীক্ষা, পরীক্ষার নম্বর দেওয়া এসব নিয়ে এত বিরক্ত লাগে যে প্রায়শই আমার মুখ দিয়ে সমালোচনা বার হয়ে আসে।”
তবু চরৈবেতি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রাক্তনীদের অবশ্য এদিন সেদিকে হুঁশ নেই। আব্দার বছর বছর প্রকাশিত হোক পুরনো আখড়গুলি।