মৃণাল সেনের মত বহুমুখী ব্যক্তিত্বের দীর্ঘ,সৃষ্টিশীল জীবনের সব কিছুই ধরা যাবে একটিমাত্র নাটকে সেটা আশাকরা বাহুল্য মাত্র।

সন্দীপন মজুমদার: বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বর সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে বাংলা থিয়েটার জগতের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল । সত্যজিত নিয়মিত থিয়েটার দেখতে যেতেন এবং সেখান থেকে বহু অভিনেতাকে নিজের ছবিতে ছোট বড় চরিত্রে নির্বাচন করেছেন। ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে বিমলার চরিত্রে নান্দীকারের স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের অভিনয়ের কথা অনেকেরই স্মরণে আছে। ঋত্বিক ঘটকের আই পি টি এ সংসর্গ, মতান্তর, থিয়েটারের জীবন নিয়ে ‘কোমল গান্ধার’ সিনেমা নির্মাণ– তাও অজানা নয় আমাদের। মৃণাল সেনও কিন্তু থিয়েটারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার একাধিক ছবিতে চিত্রনাট্য রচনার আংশিক বা পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়।
অনুমান করা যায়, সত্তর দশকের গোড়ায় কলকাতার থিয়েটারে বের্টোল্ট ব্রেখটের নাটক মঞ্চায়নের যে জোয়ার এসেছিল মৃণাল তার দ্বারাও কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অন্তত কলকাতা ট্রিলজির তিনটি ছবি এবং ‘কোরাস’ ছবির আঙ্গিক সেই কথাই বলে। ফলে বাংলা থিয়েটারের তরফ থেকেও মৃণালের জীবন ও শিল্পকর্মের আধারে তাঁর সময়, শিল্প, জীবনদর্শন ও রাজনীতিকে ছুঁয়ে দেখার একটা প্রয়াস জরুরী ছিল। সেই প্রচেষ্টাই আমরা দেখলাম ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠী আয়োজিত ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’র নবম দিনে ১৬ ই ডিসেম্বর রবীন্দ্র সদনে সমুদ্র গুহ নির্দেশিত স্পন্দন প্রযোজিত নাটক ‘ পদাতিক মৃণাল’ নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে।
স্পন্দনের ঐতিহ্য অনুযায়ী এই নাটকও একটি নিখাদ ডকু-ড্রামার উদাহরণ। একই সঙ্গে এটি এক জীবনীমূলক নাটকও বটে। সঙ্গে রয়েছে পেছনের পর্দায় মৃণাল সেনের বিভিন্ন সিনেমা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশের প্রক্ষেপণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের ক্লাস থেকে এই নাটকের মৃণাল চর্চার শুরু যেখানে চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন মৃণাল সেন—তাঁর শিল্পের দর্শন, রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা বলতে। এর পর মঞ্চে আসেন একে একে গীতা সেন, সত্য বন্দোপাধ্যায়, অনুপকুমার, কে কে মহাজনের মত চরিত্ররা যাঁরা মৃণাল সেনের জীবন ও শিল্পের আধারকে পরিপুর্ণতা দিয়েছিলেন। রেফারেন্স হিসেবে আলোচনায় এসেছে পি সুন্দরাইয়া, হরেকৃষ্ণ কোঙার থেকে আন্তনিও গ্রামশ্চির মত মার্কসবাদী ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গ। এমনকি সাদাত হোসেন মান্টো, প্রেমচাঁদ মুন্সীর প্রসঙ্গ আলোচনায় মঞ্চে হাজির হন মৃণাল সেনের ‘অন্তরীণ’ ছবিতে অভিনয়ের সূত্রে ডিম্পল কাপাডিয়ার চরিত্র।
না, মৃণাল সেনের মত বহুমুখী ব্যক্তিত্বের দীর্ঘ,সৃষ্টিশীল জীবনের সব কিছুই ধরা যাবে একটিমাত্র নাটকে সেটা আশাকরা বাহুল্য মাত্র। অনালোচিত আছে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের পর তাঁর দীর্ঘদিন ছবি না করতে পারার প্রসঙ্গও । কিন্তু মৃণাল সেনের শিল্পী চরিত্রের যে দিকটায় এই থিয়েটার গুরুত্ব দিতে চেয়েছে তা হল তাঁর আপোষহীনতা, প্রতিবাদধর্মিতা ও শৈল্পিক চলিষ্ণূতা। তাই শেষ দৃশ্যে কলকাতা মহানগরীর প্রতিবাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত রাস্তায় অর্ধশায়িত মৃণাল সেনের আসল ছবির সঙ্গে মিলে যায় মঞ্চের ওপর অভিনীত মৃণাল সেনের চরিত্র। মৃণালকে নিয়ে এক তথ্যচিত্রের নির্মাণকে কেন্দ্র করে যে সাব টেক্সট এই থিয়েটারের মূল টেক্সট হয়ে ওঠে তা যে চলমান থাকবে সেই আশ্বাসে নাটক শেষ হয়।
মৃণাল সেনের চরিত্রে প্রবীর ঘোষের নির্বাচন যথাযথ। তাঁর রূপসজ্জা, কন্ঠস্বর, বাচনভঙ্গী মৃণাল সেনের নাট্যমূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠায় অনেকটাই সফল। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকায় দেবাশিস সিনহার মেক আপ খুব ভালো হলেও মৃণাল সেনের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তাঁকে অতটা গৌণ ভূমিকায় দেখে মন ভরে নি। বিশেষত সত্য বাবুর পাণ্ডিত্যের খ্যাতিও কিছু কম ছিল না যখন।
মেক আপ এবং অভিনয় , উভয় দিক থেকেই ব্যর্থ মনে হচ্ছে মৃণালের সহধর্মিনী গীতা সেনের চরিত্রটি। গীতা সেনকে নিছক গৃহবধূ বানিয়ে বাজারের হিসেব রাখা আর পোষাক গোছানোর ভূমিকায় সীমায়িত রাখা হল কেন বুঝলাম না। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নাটক, সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গও যথেষ্ট এসেছে। চলমান রাজনৈতিক আবহে মৃণাল সেনের মত আপোসহীন, জিজ্ঞাসাতুর, নিরীক্ষাময় শিল্লীর জীবনকে সম্পর্কিত করে দেখা – ‘বাম সাংস্কৃতিক’ মহলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই জরুরী কাজটি সম্পন্ন করার জন্য স্পন্দন এবং নির্দেশক সমুদ্র গুহকে ধন্যবাদ।