
সন্দীপন মজুমদারঃ সমস্ত অনুভূতি বিবশ, মূহ্যমান। যে আনন্দপিপাসু পর্যটকরা কাশ্মীরের পহলগামে প্রাণ হারালেন সন্ত্রাসীদের নির্বিচার, নির্মম গুলিতে তাদের জায়গায় ঠিক পনের দিন আগে আমি নিজেই ছিলাম পরিবারসহ। কাশ্মীর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি,কাশ্মীরি মানুষদের আন্তরিক ব্যবহার, প্রাকৃতিক অপার্থিব সৌন্দর্য – এসবই সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে ভেবেছিলাম। সমস্তটা এক বিকেলের অগ্নুৎপাতে নষ্ট হয়ে গেল। যতটা ভয় হল , ততটাই হল কষ্ট। সুন্দরকে গলা টিপে খুন হতে দেখার কষ্ট, মানুষের বিশ্বাসকে নষ্ট হতে দেখার কষ্ট।রুদ্ধবাক অবস্থাটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে কষ্ট বাড়ল।

দেখা গেল মানুষের বিভাজিত, সাম্প্রদায়িক চেহারা। কিছু ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীর জন্য গোটা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে দোষী করা হতে থাকল। কদর্য হুংকার শোনা যেতে থাকল কুরাজনৈতিক নেতার গলায়—কাশ্মীরকে গাজা বানিয়ে দেব। টিভির চ্যানেলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে অ্যাংকরের বেআইনি হুমকি শোনা যেতে লাগল – সেকুলাররা দেশ ছাড়। অথচ এই দাবী সংবিধানবিরোধী। ভারত ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় আর সেকুলাররাও সন্ত্রাসী নয়। বরং সমস্ত রকম ধর্মীয় সন্ত্রাসের আক্রমণের লক্ষ্য থাকেন সেকুলাররা। কে কাকে কী বোঝাবে ?

এই পরিস্থিতিতে আমাদের আঁকড়ে ধরার মত খবর কাশ্মীর থেকেই এসেছে। ঘোড়া চালক আদিল শাহের বীরত্বসূচক শাহাদাতই শুধু নয়, ছোট বড় অনেক মানবিকতার কাহিনী সামনে আসছে। গোটা কাশ্মীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভ দেখিয়েছে এই ঘটনায়। অনেকে বলছেন এই বিক্ষোভ নাকি স্বার্থসঞ্জাত ও লোকদেখানো। না , কাশ্মীরের সব অধিবাসীরা ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন—ইতিহাস এমন কথা বলে না। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার পক্ষে সেখানে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন যে বড় বিষয় এটা তো দুগ্ধপোষ্য শিশুও বুঝবে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কাশ্মীরি নাগরিকদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করলে ( যেমনটা দেরাদুনে কাশ্মীরি ছাত্রদের সঙ্গে করা হয়েছে ) সেই প্রক্রিয়া যে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা কী আমরা বুঝব?

বহরমপুরের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত বছরখানেক আগে কাশ্মীরে দিন দশেকের ভ্রমণে গিয়ে জলরঙে প্রাকৃতিক দৃশ্য ও কালি কলমে মানুষের ছবি বেশকিছু এঁকেছিলেন। ২৯ মার্চ ২০২৩ প্রকাশিত হয় ‘ পাহাড়ি কাশ্মীর’ শীর্ষক সিরিজে সেখানকার মানুষদের ছবি এবং তাঁদের সম্পর্কে দুএকটি কথা। ছবিগুলি সম্প্রতি আবার দেখার সুযোগ হল। পহলগামে উইলোগাছের নীচে দুই কাশ্মীরি বালক, গরীব ব্যাগওলা, মায়ের সঙ্গে কিশোরী, কাওয়া বিক্রেতা, উইলোকাঠের ব্যাটবিক্রেতা, ডাললেকের ধারে মালাবিক্রেতা, বেকারির বিস্কুটবিক্রেতা, বরফঠেলা পথে ঘোড়সওয়ার, মশলা ওশুকনো ফলবিক্রেতা, ডাললেকের শিকারাচালক—– বিভিন্ন চরিত্রকে তাঁর স্কেচের মাধ্যমে প্রাণময় করে তুলেছেন কৃষ্ণজিৎ।

প্রতিটি চরিত্র তাদের পটভূমির মধ্যে নিজেদের নিঃসঙ্গতা, শ্রম , আনন্দযাপন, সাহচর্য আর প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয়ে জীবন্ত। এই ছবিগুলির তাৎপর্য এখানেই। যেখানে কাশ্মীরের মানুষের অপরায়ন ( Otherisation) ঘটানো হচ্ছে, মনে করা হচ্ছে তারা সবাই যেন মনুষ্যেতর সন্ত্রাসবাদের সমর্থক, ইতিহাসের খলনায়ক। কাশ্মীরের মানুষকে যোগ্য মর্যাদায় দেখা, অপরায়ন বা দানবায়নের প্রচেষ্টা যা গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের বৃহদংশে দেখা যায় তার বিরুদ্ধে আমাদেরই মত হাসিকান্না, দুঃখ, দারিদ্র এবং মানবিক অনুকম্পায় কাতর কাশ্মীরি মানুষের চেহারাটা বের করে আনা দরকার।
সেই কাজ একজন শিল্পী যেভাবে পারেন কৃষ্ণজিৎ সেই চেষ্টা করেছেন। গত বছর এই সন্ত্রাসবাদী ঘটনার পটভূমি ছিল না। কিন্তু আজ এক বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে ছবিগুলি নতুন তাৎপর্যে ধরা দিচ্ছে। আসলে মানুষ তো এরকমই—আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকে। আমরা সেদিকে তাকাব না মুখ ফিরিয়ে নেব তা আমাদের মানবধর্মের ওপর নির্ভর করবে যেটা বাদ দিলে কোনো ধর্মেরই কোনো মানে থাকে না।