আসলে মুখে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলা যত সহজ, মাঠে নেমে সমীক্ষা করে লোককে নিজের ঘরে টেনে আনা অত সহজ নয়।

বিদ্যুৎ মৈত্রঃ গেরুয়া ঝড়ে ঝাড়ু বিদায়। আপাতত আম আদমি পার্টির মধ্যবিত্ত তকমা সরিয়ে দিল্লিবাসী সাদরে গ্রহণ করেছে ভারতের শাসকদল বিজেপিকে। আর এই জয় পেতে বিজেপিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২৭ বছর। তবে বিজেপি’র এই জয়ে খুশি হওয়ার কথা কংগ্রেসের। প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করে দিল্লির কুর্সী থেকে সরতে হয়েছিল প্রয়াত কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী শিলা দীক্ষিতকে। আর তা সরিয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
একসময় ভারতবাসী ভেবেছিলেন ‘দুর্নীতিগ্রস্থ’ কংগ্রেসকে সরিয়ে দেশবাসীকে নতুন দিশা দেখাতে পারেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল। কিন্তু দিল্লিবাসীর ভরসাই রাখতে পারেননি আপ নেতা কেজরিওয়াল। আর সেই সুযোগকে সুনিপুণ কৌশলে ব্যবহার করে দিল্লিবাসীর ঘরে পদ্ম ফোটাতে সাহায্য করল সোনিয়া গান্ধির দল। ভোটের ফল ঘোষণার পর রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের এই মত যদিও নির্বাচনের আগে দাবি করেছিলেন কেজরিওয়াল।
তবে দেশে বিজেপি তথা এনডিএ জোটের বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার অংশীদার কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি। আর তাদের দোসর তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বাম শাসনকালকে উপড়ে দিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে জোড়াফুল। ধীরে ধীরে তারা বাংলায় থাবা বসিয়েছে বলে অভিযোগ বাম, কংগ্রেস এমনকি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিরও। দিল্লি জয়ের পর বিজেপি নেতাদের অনেকের দাবি ” বিজেপি যদি হিন্দুত্বের রাজনীতিই করতো তাহলে দিল্লি জয় সম্ভব ছিল না।” তাঁদের স্পষ্ট ইঙ্গীত দিল্লির মুসলমানরা। বাংলার সেই সব বিজেপি নেতারা গতকাল থেকে প্রচার করা শুরু করেছেন দিল্লির আপের পর বাংলার ‘পাপ’ বিদায় নেবে। বহরমপুরের বিজেপি নেতা শাখারভ সরকারও সেই পথেই নিশান তুলে শনিবার ঢাক ঢোল পিটিয়ে অন্য নেতাদের মতো জয় উদযাপন করেছেন শহরে।
কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। বাংলার মাটি থেকে সিপিএম সহ বাম দলগুলিকে ক্ষমতাচ্যূত করতে তৃণমূলের কতদিন সময় লেগেছিল? দলটির জন্ম ১৯৯৮ সালে। ক্ষমতায় এসেছে ২০১১ সালে। ১৪ বছর চলছে তার শাসনকাল। দলটি শতভাগে বিভক্ত। অনায়াসে চোখে পড়ে ফাটলের চিহ্ন। নরেন্দ্র মোদি , অমিত শাহরা অনেক চেষ্টা করেছেন ইডি আর সিবিআইকে দিয়ে রাজ্যে অভিযান চালিয়ে দলের ভাবমূর্তিতে চিড় ধরাতে। কিন্তু আপ দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গরাদের অন্ধকারে ঠেলতে পারেননি। গরাদের আড়ালে পাঠানো সম্ভব হয়নি ‘যুবরাজ’ অভিষেককেও। যাদের সেখানে ঠেলেছেন তারাও একে একে গরাদের বাইরে বেড়িয়ে এসে পদ্মের অভিসন্ধী ফাঁস করে দিয়েছেন। তাহলে ? তৃণমূল নেতা কুনাল ঘোষ বলেই দিয়েছেন “দিল্লি আর বাংলা এক নয়। ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ২৫০-র বেশি আসন পাবেন। চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
যে মানুষের ওপর ভরসা করে শাখারভের মতো নেতারা বাংলা থেকে “পাপ” বিদায়ের স্বপ্নে মশগুল তারা কী একবার নিজেদের দিকে তাকাচ্ছেন? কুনাল ঘোষের দাবি নস্যাৎ করার চেষ্টা করছেন মরিয়াভাবে। আপনারা সত্যিই যদি মুর্শিদাবাদের মতো সংখ্যালঘু অধ্যূষিত অঞ্চলে ক্ষমতা চান তাহলে আপনাদের শক্তি কোথায়? কাল যাদের নিয়ে গেরুয়া আবির উড়িয়েছেন সেখানে কত ভিড় হয়েছিল? সদ্য শেষ হয়েছে আপনাদের সদস্যপদ সংগ্রহ অভিযান। নতুন শুভাকাঙ্খী বা আপনাদের পক্ষে বলে যে প্রচার অহরহ করছেন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাও আসলেন না কেন? পাশে দাঁড়ালেন না কেন? তৃণমূলের ছাত্র পরিষদের এক ডাকে হাজার লোক জুটে যায়। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ‘লাস্ট বয়’ সিপিএমের যুবরা তো এর থেকে ঢের বেশি জমায়েত করতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেসকে আমআদমির মতো ক্ষমতাচ্যূত করতে মরিয়া কংগ্রেসের সঙ্গেও আপনাদের সখ্য নেই বঙ্গে। সিপিএমের সঙ্গে যদিও বা থাকে তাতেও আপনাদের হয়ে আড়ালেও তারা গলা ফাটালে ভিড় কিঞ্চিত চুঁইয়ে পড়ত। তাহলে আপনি শাখারভ কোথায় পিছিয়ে একটু বলবেন?
এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাফল্যের কাহিনী। আর তা বিলক্ষণ জানেন বলেই কুনাল ঘোষরা সদর্পে বলতে পারেন তারা ফের ক্ষমতায় ফিরবেন। আসলে মুখে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলা যত সহজ, মাঠে নেমে সমীক্ষা করে লোককে নিজের ঘরে টেনে আনা অত সহজ নয়। নিমন্ত্রণের বাহারি কার্ড হাতে দোরে দাঁড়ানো যায়, কিন্তু আমন্ত্রণে আন্তরিকতা না থাকলে বিয়ের সানাই বাজবে ঠিকই বাসি খাবার খাওয়ানোর লোক মিলবে না যে।