বিদ্যুৎ মৈত্র, মুর্শিদাবাদঃ প্রবাদ আছে, প্রেমে আর যুদ্ধে সবই ন্যায়সঙ্গত (All Is Fair in Love and War)। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনও এক অর্থে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের কৌশলে বাজিমাত করেছে তৃণমূল। ফল ভুগেছে বাম আর কংগ্রেস। চোট পেয়েছে পদ্মও। অন্তত মুর্শিদাবাদের তিন আসনের ফলাফল সেদিকেই আঙুল তুলেছে। যদিও চর্চায় কেবলমাত্র বহরমপুর। বাকি দুটিতে শাসকদলের জেতা আসন ধরে রাখায় চর্চা কম রিয়াল ও ভার্চুয়ালে।
বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীর ডানা ছাঁটা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকে। তবুও বাগে আনা যায়নি। চলতি বছরের নির্বাচন ধরলে দুটি লোকসভা নির্বাচন হয়েছে গত আট বছরে। ২০১৯ সালে অধীর চৌধুরী যে মার্জিনে জিতেছিলেন তার থেকে ৪ হাজার ২৫৮ ভোট চলতি নির্বাচনে বেশি পেয়েছেন তৃণমূলের ইউসুফ পাঠান। হেরেছেন চৌধুরী।
তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে লোকসভায় যে কান্দি, বড়ঞা আর বহরমপুর অধীরের পাশে ছিল সেই তিন বিধানসভার মধ্যে একমাত্র বহরমপুরের মানুষ অধীরের হাত ছাড়েননি শেষবেলা পর্যন্ত। সাত বিধানসভার মধ্যে কংগ্রেস একমাত্র বহরমপুরে এগিয়ে। বহরমপুর পুরসভাতেও এগিয়ে কংগ্রেস। অধীর সবথেকে বেশি ভোট পেয়েছেন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। বিজেপি বেশি পেয়েছে এক নম্বর ওয়ার্ডে। তিন নম্বরে তৃণমূল।
আবার উল্টোদিকে বিজেপি’র বিধায়ক সুব্রত মৈত্র দলের সঙ্গে বিবাদের জেরে কংগ্রেসের হয়ে ভোট করিয়েছে বলে রটনা, তাঁর দলেরই একাংশের। তাঁদের দাবি, নিজের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডেই হেরেছেন বিধায়ক। যা কংগ্রেসের থেকে কম, তৃণমূলের থেকে বেশি। বিধায়ক অবশ্য বলছেন ” সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওয়ার্ড থেকে এর বেশি কত ভোট পাব? বিধানসভাতে আমিও কম ভোট পেয়েছিলাম।” তবে হিন্দু অধ্যুষিত ২০ নম্বর ওয়ার্ডেও পিছিয়ে বিজেপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দাবি, হিন্দু ভোট কাটাকাটিতেই হেরেছেন অধীর।
বহরমপুর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতলেও সাংগঠনিক দূর্বলতার কারণে বিজেপি’র ভোট যে লোকসভায় কমবে তা নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন বিজেপি’র জেলা নেতারা তো বটেই রাজ্য নেতাদের একাংশও। জেলা নেতাদের সঙ্গে চিন্তার ফারাক খুব একটা বেশি ছিল না তাঁদের। অথচ ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বহরমপুর লোকসভায় বিজেপি পেল ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৮৮৬টি ভোট। গত বছরের তুলনায় দু’লক্ষ ২৮ হাজার ৮৪৮ ভোট বেশি।
কোথা থেকে এল এই ভোট? শুনতে তৃণমূল নেতাদের খারাপ লাগলেও সত্যি, ভোট ভাগাভাগির কৌশল নেওয়া হয়েছিল তৃণমূলেরই ওয়ার রুমে। জেলায় সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন হিন্দু নেতাদের একটা বড় অংশ। নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়, অপূর্ব সরকারের মতো মাথারা তার অংশীদার। হুমায়ুন কবীরের নাম আলাদাভাবে করে রাখা উচিত।
কারণ কী? বাংলা মেরুকরণের রাজনীতি প্রভাবমুক্ত তো নয়ই বরং এখানে নির্বাচন হয় ধর্মের ভিত্তিতে, প্রথমসারির পর্যবেক্ষকরা এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন। সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে কালীঘাট উঠেপরে লেগেছিল। বহরমপুর, কান্দি আর বড়ঞা মূলত হিন্দু প্রধান বিধানসভা। ইউসুফ পাঠানকে প্রার্থী করায় আশঙ্কিত ছিলেন অধীর। মুসলমানরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এই ভয় থেকে। আর ওখানেই লুকোনো ছিল টিম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাস।
প্রার্থী পদ নিয়ে হুমায়ুন কবীরের গোঁসা (?) সহ নাড়ুগোপাল, অপূর্বদের মতো একাংশ নেতার ঘনিষ্ঠরা বাজারে ছড়িয়ে দিলেন নিজের নিজের দাদাদের নাম। তাঁরা প্রার্থী হলে হেলায় হারানো যেত অধীর চৌধুরীকে। কিন্তু দিদি তলায় তলায় অধীরকে জেতাতে চান তাই এইরকম একজন ভিনদেশিকে বহরমপুরে পাঠিয়েছেন। এরফলে তৃণমূল হারবে। অধীরকে হারানো সম্ভব নয়। দূর্বল বিজেপি’র কানেও এই কথা ঢুকেছিল। ঝড়ে বক মরে প্রবাদে ভর করে সেই গুঞ্জনের স্রোত তলিয়ে না দেখে গা ভাসালেন একাংশ বিজেপি নেতাও। তাতে কাজ হাসিল করা সুবিধা হল তৃণমূল নেতাদের।
বহরমপুর শহর নির্বাচনের আগে শুনল চাপাস্বর। কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসবে না। ইউসুফকে জেতালে মুসলমানরা ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসবে। ভরসা একমাত্র বিজেপি। হুমায়ুন নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন দিলেন উস্কানিমুলক (সাজানো?) বক্তব্য। ভোটের দিন নিঃশব্দে ভোট হল। ফলাফলে দেখা গেল জনতার ভোটে জিতেছে তৃণমূল, হেরেছেন অধীর। পরিকল্পনা সফল। নিরপেক্ষতা নয় ধর্মের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন মানুষ।
পর্যবেক্ষকদের দাবি, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করেছে বিজেপি। জিতল তো নাইই। উল্টে অধীরকে হারিয়ে দিল। নাড়ুগোপাল বলছেন, “অধীর চৌধুরীকে হারাতে যতরকমের কৌশল অবলম্বন করতে হয় সব রকম কৌশল নেওয়া হয়েছিল। তাতেই জয় এসেছে।” মানুষকে বোঝানো সহজ হল, হারা আসন বহরমপুরের মানুষ শাসক বিরোধী ধারা বজায় রেখেছে। আর বহরমপুরের বিধায়ক বলছেন, “আমাদের ভোট ভাগ না হলে আমরাই জিততাম।”
আরও পড়ুনঃ সাংসদের চেয়ার আগলে থাকবেন ‘ভরত’রা