এর জের আমাদের সারাজীবন টানতে হবে

Social Share

মুর্শিদা খাতুনঃ আমি মনে করি মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাসে আজ একটা কলঙ্কিত দিন। এতদিন যা মানবতার ধ্বংসের দিন হিসেবে চিহ্নিত ছিল সেই দিনটি বেলডাঙার সঙ্গে জুড়ে গেল অন্যভাবে। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে বেলডাঙার মাটিতে যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হলো তা একদিন মহিরুহে পরিণত হবে। এই মুর্শিদাবাদ অশান্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। এর ফল আমাদের ভুগতে হবে। আমরা মানুষকে সত্যিটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।

মুসলিম প্রধান জায়গা বেলডাঙা হলেও এখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে এতদিন বসবাস করেছি। বিগত কয়েক বছর ধরে এখানে নিকৃষ্টভাবে সাম্প্রদায়িকতার চাষ করা হচ্ছে। মাথাচাড়া দিচ্ছিল হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদ। এতদিন যেটা অন্তরালে ছিল আজ সেটা খুল্লামখুল্লা হয়ে গেল হুমায়ুন কবীরের দৌলতে। রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় তিনি নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে দেশের একটা দগদগে ক্ষতের দিনকে বেছে নিয়েছিলেন আগেই। ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে বাবরি মসজিদের শিলান্যাসের ঘোষণা করেছেন। জানি না আজকের পর কোন দিকে বাঁক নেবে সমাজ। তারজন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

বেলডাঙার মধ্যে পড়লেও আমাদের স্কুল থেকে ঘটনাস্থল অনেক দূরে। স্কুল যাওয়ার পথেই দেখছিলাম মানুষজন কীভাবে ছুটে চলেছেন জাতীয় সড়ক ধরে। যেমন আগুনের দিকে ছুটে যায় পতঙ্গ, ঠিক তেমনই লাগছিল মসজিদের শিলান্যাসের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাওয়া মানুষের উন্মাদনা। শুধু লোক আর লোক। হাতে তাদের সমান আকারের নতুন কাপড়ে তৈরি পরিস্কার পরিচ্ছন জাতীয় পতাকা। সাধারণ গ্রামের মানুষ এসব পেল কোথা থেকে। যা দেখে মনে হয়েছে এই কান্ডের পেছনে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল। সমাজ মাধ্যমে প্রচার করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মসজিদের শিলান্যাসের কথা ঠিকই, কিন্তু তা কখনোই এতো মানুষকে সংগঠিত করতে পারে না।

একইভাবে যেভাবে কাতারে কাতারে মানুষ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইঁট, বালি মাথায় করে, গাড়ি করে নিয়ে এসেছেন তাও হঠাৎ করে আনা সম্ভব নয়। হঠাৎ করে কিছুই হয়নি। সাদা চোখে দেখেই মনে হবে এর পেছনে একটা বড় নেটওয়ার্ক কাজ করেছে। এটা পরিকল্পিত বলে মনে হয়েছে। আজ তার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। মুসলমান সমাজের মানুষ আমরা ৬ ডিসেম্বর দিনটি চাপা দিয়ে রেখেছিলাম এতদিন। আবার সেই খুঁটি পোঁতা হল এখানে। এই নাম যতদিন থাকবে, এই তারিখ যতদিন থাকবে বিপরীত মৌলবাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর রাস্তা ততদিন পাল্টা খোলা থাকবে।

আজকের পর থেকে জেলায় সম্প্রীতির কথা বলতে গিয়ে চিন্তা হবে। এর আগেও বেলডাঙাকে বারেবারে কালীমালিপ্ত করা হয়েছে। এনআরসি কান্ডে জেলা উত্তপ্ত হয়েছে। থানা ঘেরাও হয়েছে। ট্রেন পুড়েছে। শক্তিপুরে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে একটা কান্ড ঘটেছে। সেক্ষেত্রেও হুমায়ুন কবীরের মতো মানুষজন ধুয়ো দিয়েছেন, বিবৃতি দিয়েছেন, ক্ষেপে গিয়ে পাল্টা বিপরীত দিকের মানুষজনও বিবৃতি দিয়েছেন। এই রাজনীতিক এখন বলছেন তাঁকে লোকসভা নির্বাচনের সময় বিভেদের রাজনীতি করতে বলা হয়েছিল। জানি না আজকের ঘটনার পর তিনি কার দিকে আঙুল তুলবেন। এদের কথাবার্তা নিয়ে কোনও আস্থা, বিশ্বাস নেই।

গর্ব করার মতো কত কিছু আছে মুর্শিদাবাদের। তেমনি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আমরা যন্ত্রণায় থাকি। আমাদের জেলার ছেলেরা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তাঁদের কাজ দিতে পারি না। যাঁরা জেলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই তাদের ক্ষেত্রে এটা লজ্জার। কত মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অল্প বয়সে। প্রসূতি মায়ের কথা উঠলে মাথা নিচু হয়। তার সঙ্গে আর একটা সংযোজিত হল এই বাবরি মসজিদের শিলান্যাস। আমাদের কোনও উপায় নেই। মানুষকে যতদিন না রাজনীতিতে শিক্ষিত করতে পারছি ততদিন এদের কবল থেকে রক্ষা নেই। মানুষ যখন বুঝবে তখন দেরি হয়ে যাবে। আমার মনে হয় আজকের ঘটনায় সবথেকে কলঙ্কিত হল বেলডাঙার সম্প্রীতির বাতাবরণ। এর জের আমাদের সারাজীবন টানতে হবে।


মুর্শিদা খাতুন বেলডাঙা এস এ আর এম গার্লস হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষিকা। একজন সমাজকর্মীও। যিনি মেয়েদেরকে আঁধার থেকে আলোয় আনার নিরলস চেষ্টা করে চলেছেন


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights