ওপারের নাটক মঞ্চস্থ হবে না এপারের নাট্যমেলায়

Social Share
ঋত্বিকের ১৫ তম নাট্যমেলার উদ্বোধক সৈয়দ শামসুল হককে সম্মান জানাচ্ছেন সুগত সেন।

সংবাদ হাজারদুয়ারি ওয়েবডেস্কঃ কাঁটাতার বেড়া উঠে গেলে আমাদের একটাই উঠোন। এই ছিল পদ্মার এপার ওপারের সম্পর্ক। ভাল নেই ওপার বাংলা। তার আঁচ লেগেছে এপারেও। গত জুলাই মাসে সে দেশে গণ অভ্যূত্থানের জেরে পতন হয়েছে নির্বাচিত সরকারের। অস্থায়ী সরকার এখনও সেদেশে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ। হিংসার আগুনে জ্বলছে চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, ঠাকুর গাঁও। মৌলবাদী তান্ডবের জেরে ভারতের সঙ্গে বেঁধেছে বাংলাদেশের সংঘাত। দিন যত গড়াচ্ছে ততই তাপ বাড়ছে সীমান্তে।

কাল বাদে পরশু বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে শুরু হবে ঋত্বিক নাট্যসংস্থার দেশ বিদেশের নাট্যমেলা। সেখানে দেখা যাবে না বাংলাদেশের নাটক। ২৪ বছর ধরে নিয়ম করে ডিসেম্বরে এগারো দিনের এই নাট্যমেলার আয়োজন করে আসছে ঋত্বিক। এবারও রবিবার আট তারিখ থেকে ১৮ তারিখ বুধবার পর্যন্ত এগারোটি নাটক মঞ্চস্থ হবে। করোনাকাল বাদ দিলে বাংলাদেশ বরাবর তাদের এই নাট্যমেলার অন্যতম অংশীদার। সে দেশের কোনও না কোনও নাট্যদল, একটি ছেড়ে কখনও দুটি দল অংশ নিয়েছে ফি বছর নাট্যমেলায়। তেমনি ঋত্বিকও নাটকের সম্ভার নিয়ে গিয়েছে ওপারে। ভাবের আদান প্রদানের সেতু ছিল নাটক।

এবারই প্রথম ছেদ পড়ল। ঋত্বিকের পক্ষে মোহিত বন্ধু অধিকারী জানান, এবার দুটি দলের আসার কথা ছিল নাট্যমেলায়। সেইরকমই কথাবার্তা এগোচ্ছিল। কিন্তু অগস্টে এসে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ভিসা নিয়ে টানাপোড়েনের পাশাপাশি সঙ্গত কারণেই এবার এদেশে আসার ঝুঁকি নিতে চাননি নাট্য পরিচালকরা। তাই এবার নাট্যমেলায় ‘না’ বলেছেন তাঁরা। আর তাতেই মন ভার নাট্যমোদিদের। দুই বাংলার এই সংস্কৃতি তৈরি করেছিলেন নৃপেন্দ্র সাহা। সে কথা জানিয়ে জলসিড়ি পত্রিকার সম্পাদক, নাট্যকর্মী অনুপম ভট্টাচার্যের মতে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে নাটক এবং বাংলার সংস্কৃতির।

তিনি বলেন, ” নাটকের আদান প্রদান শুধু কলকাতা বা বড় শহরের সঙ্গেই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরের নাট্যদলগুলি যে কাজকর্ম করছে সেটা বহরমপুর, কল্যাণী, কৃষ্ণনগর, বালুরঘাট, জলপাইগুড়িতেও মঞ্চস্থ হয়েছে। তেমনি এখানকার ছোট দলগুলি যারা কলকাতা মুখাপেক্ষি নয় তারাও সে দেশে যেত নাটক নিয়ে। দু -বাংলার দর্শকেরা তা দেখতে পাচ্ছিলেন। এরফলে মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি হচ্ছিল। আমরা চাই আবার সবকিছু স্বাভাবিক হোক। সংস্কৃতির আদান প্রদান হোক। থিয়েটারের আদানপ্রদান হোক। একমাত্র থিয়েটারই পারে মানুষকে বেঁধে বেঁধে রাখতে।”

শুধু ঋত্বিকের ডাকেই নয় বহরমপুরের বেশ কয়েকটি নাট্যদল নাটকের মরশুমে নাট্যপ্রেমীদের বাংলাদেশের নাটক দেখার সুযোগ করে দিত। সেই দলের নাট্যোৎসব হয়ে উঠত আন্তর্জাতিক। এদেশের নাট্যকারের লেখা নাটক ওদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। ওদেশের লেখা নাটক এদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। ২০১৫ সালে ঋত্বিকের নাট্যমেলায় এসেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর লেখা নাটক “চম্পাবতী” একাধিকবার প্রশংসার সঙ্গে মঞ্চস্থ করেছে ঋত্বিকের মতো বাংলার একাধিক নাট্যদল। গত বছর ঢাকার শব্দ নাট্য চর্চা কেন্দ্র এই নাট্যমেলাতেই মঞ্চস্থ করেছে ” কী চাহ শঙ্খচীল ” এখন ঢাকাতেই থিয়েটারের ঝাঁপ নামাতে বাধ্য হচ্ছেন নির্দেশকরা।

বাংলাদেশের নাট্যদলগুলির অনেকের সঙ্গে বিশ বছরেরও বেশি নিবিড় যোগ আলোকশিল্পী শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে শামুর। ওদেশের বন্ধুদের সঙ্গে এখন তাঁর হোয়াটস অ্যাপেও কথা চালাচালি হয়। শ্যামাপ্রসাদ বলেন, ” খারাপ লাগছে। ওরাও অসহায়। নাটক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের খুব ক্ষতি হয়ে গেল।” পড়শি দেশে শামু যখনই আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন নাট্যদলের সঙ্গে, সেখানে পেয়েছেন উষ্ণ আতিথেয়তা। কত গল্প, কত আড্ডা মেরেছেন একসঙ্গে। রাত কেটে গেছে নাটকের কথায়। এবার সেই বন্ধুরাই আসতে পারছেন না শামুর শহরে।

তাই মনও খারাপ। বললেন, ” আমরাও যেতে পারছি না ওদেশে। অনেক ছোটবেলা থেকে দেখছি বাংলাদেশের নাটক। দেখেছি রবীন্দ্রনাথকে কী গভীরভাবে ভালবাসত ওরা। অনন্ত হীরার ২৫টি প্রযোজনার মধ্যে ২৩টিই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। সেই রবীন্দ্রনাথ আজ ওদেশে লাঞ্ছিত। তাঁকে নিয়ে কুৎসা করছে। আর এসব ভাল লাগছে না।”

এসব বন্ধ হয়ে কবে যে বাংলাদেশ আবার নাটকের মঞ্চে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কি না সেই আশা নিরাশায় দুলছেন শামুর মতো অনেকেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights