আক্ষরিক: ইতিহাসের জনজীবন 

Social Share
নাটকের দৃশ্যের ছবি ঋত্বিকের ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত

অম্লান দত্তঃ আক্ষরিক প্রকৃতপক্ষে আক্ষরিকতার গল্প হলেও তা আসলে আক্ষরিকতাকে পেরিয়ে জীবনের ভাবগত অর্থ খোঁজার প্রয়াস; রজত চক্রবর্তীর উপন্যাস অবলম্বনে রচিত এই নাট্যে বিবৃত হয়েছে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর অবহেলিত শিল্পী বাংলার প্রথম অক্ষর কারিগর পঞ্চানন কর্মকারের জীবনকথা। 

নাটকের শুরুতেই মঞ্চের পাটাতনে বসে বিড়ি ফুঁকতে থাকা বয়স্ক লোকটি একবার মরে গিয়ে, আরেকবার বেঁচে উঠে নাটকের অন্দরে প্রবেশ করেছেন অনায়াস দক্ষতায়; হয়ে উঠেছেন কথক, প্রধান চরিত্রাভিনেতা  এবং দর্শক। আমাদের মনে পড়ে বাংলার আবহমান যাত্রাপালায় এইসব সাধারণ অথচ অসাধারণ দৃশ্যাবলীর কথা যেখানে চরিত্রাভিনেতারা নাটকের ফাঁকে বা তার আগে পরে তাদের নিজেদের চরিত্র ছেড়ে বাস্তবে বা বাস্তব ছেড়ে চরিত্রে অনায়াসে গতায়াত করে থাকেন প্রতিনিয়ত ।

গোটা নাটকের অন্তরে এইভাবেই বহমান বাংলা নিজস্ব সামাজিক- সাংস্কৃতিক ধারা; তা সে সংগীতের মাধ্যমেই হোক বা মঞ্চ-উপকরণেই হোক। পঞ্চাননের ভূমিকায় একই সাথে তিনজন অভিনেতা-কিশোর, যুবক ও বয়স্ক- অতিস্বচ্ছন্দে অভিনয় করেছেন; কখনো একে অন্যের বিকল্পে, আবার কখনো একে অন্যের যন্ত্রণাকে মুর্ত করতে। পঞ্চাননের ছোটবেলায় কারিগরি দক্ষতার প্রকাশ থেকে শুরু করে যুবক এবং বয়স্ক অবস্থায় নতুন করে অক্ষর গড়ার স্পৃহা এবং আরও  পারফেকশনের দিকে যাত্রা প্রতিটিই যেমন মঞ্চে ফুটে উঠেছে অনাবিল দক্ষতায়, তেমনি তার পাশাপাশি বাংলার তৎকালীন ইতিহাসের ধারা বর্ণনার গুনে ভাস্বর হয়ে উঠেছে দর্শক দরবারে।

এক বিরাট কালখন্ড যেন মঞ্চে উপস্থিত তার জীবন্ত ধুকপুক নিয়ে; তাতে সঙ্গী যেমন দড়ি, শাড়ি, হাতেগড়া কাগজের নৌকো তেমনই  সংগীতের মূর্ছনা এবং অনুপম শারীরিক ও বাচিক অভিনয়। কখনো লম্বা বেঞ্চি হয়ে ওঠে গঙ্গার বুকে ভাসমান বিরাটকায় জাহাজ, কখনো তা হয়ে ওঠে নদীর পাড়ে থাকা আঘাটা, কখনো চেয়ার হয়ে ওঠে ছাপাখানার মেশিন; থিয়েটারের অমিত সম্ভাবনাও যেন মুর্ত হয়ে ওঠে মঞ্চে। উইলিয়াম কেরি, হ্যালহেড তথা উইলকিন্স সহ অন্যান্যদের বাংলা ভাষা ছাপার অক্ষরে প্রচারের প্রাথমিক পর্বে অবিস্মরণীয় অবদানের কথা মঞ্চে এসেছে সহজ ভঙ্গিতে এবং চলতি হাসি-ঠাট্টার দৃশ্যে। সেই সঙ্গে এসেছে পঞ্চানন কর্মকারের উপেক্ষিত কর্মের কথা যার প্রচার এই নাট্যের প্রধান উপজীব্য। 

মঞ্চভাবনায় এবং মঞ্চ উপকরণে যথারীতি দেবাশিসের থিয়েটারি ইমাজিনেশন তার অসাধারণত্ব নিয়ে উপস্থিত। কাঠের ব্লক থেকে বের হয়ে আসা একটি নলসহ হাতুড়ি হয়ে ওঠে মাতৃগর্ভ থেকে বেরোনো কারিগর সদ্যোজাত পঞ্চানন; মেটাফর এবং ব্যঞ্জনায় ভরা এই ইমেজ নির্মাণ এক পরমপ্রাপ্তি যা সহজ অথচ গভীর বোধের জন্ম দেয়। বাংলার আবহমান সংগীত এবং ব্রিটিশ সঙ্গীত তাদের নিজস্ব দক্ষতায় দৃশ্যের মুড এবং টেম্পারকে করে তুলেছে ব্যঞ্জনাময় এবং গভীর। আবার এই সংগীত সৃষ্টির জন্য চিরাচরিত সংগীত উপকরণের সাথে হাতুড়িপেটার শব্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে- যা নাটকের অন্দরে বুনে দিয়েছে অক্ষরমালা গডার এক অনুপম কারিগরি সংগীত- ‘ওরা কাজ করে’- এবং তা এই নাটকের মূল সুর হয়ে উঠেছে। আলোর পেলবতা, মায়া এবং দৃঢ়তা নাট্যের প্রয়োজন অনুসারে উদ্ভাসিত এবং প্রযুক্ত। মঞ্চ উপকরণে মনে থেকে যায় জনজীবন এবং লোকসাধারণ বোঝাতে অভিনেতাদের মুখে গামছার ব্যবহার। গ্রীক মুখোশের বদলে এই তো আমাদের নিজস্ব উত্তরাধিকার। 

তবে বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে ঋত্বিকের দেশ-বিদেশের নাট্যমেলায় উপস্থাপিত এই নাট্যে কিছু খামতি ছিল যা থিয়েটারের জীবন্ত হওয়ার আরেক প্রমাণ। বয়স্ক পঞ্চানন মাঝে মাঝে সংলাপ ভুলেছেন, জড়িয়েছেন কথা এবং সহ-অভিনেতার সঙ্গে কথার আদান-প্রদানও ব্যাহত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ এক অনুপম নাট্য যা উপেক্ষিত ইতিহাসকে মূর্ত করেছে অপূর্ব সুষমায় এবং আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের ইতিহাসের সাংস্কৃতিকবোধ এবং উত্তরাধিকার।

আরও পড়ুনঃ ‘অনপেক্ষিত’ নাটক হয়েও হয়ে উঠতে পারেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights