বিদ্যুৎ মৈত্র, কলকাতাঃ মোহ মুক্তি ক’জনের ঘটে? যাঁরা মায়া, মোহ ত্যাগ করতে পারেন তাঁরা সাধক। পার্থিব যা কিছু অর্জন করে ডিম থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠা যায় সেসবই এই ইহলোকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার নাম জীবনচক্র। তবু মায়া কাটানো যায় কি? কবি তো কবে বলেছেন “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে /মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই/ এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে/ জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।”
এও এক মোহ। গীতায় বলা আছে- ” তোমার কি হারিয়েছে, যে তুমি কাঁদছ ?/ তুমি কি নিয়ে এসেছিলে, যা তুমি হারিয়েছ?/ তুমি কি সৃষ্টি করেছ, যা নষ্ট হয়ে গেছে?” এই উপলব্ধি যে না করে, সংসারে তারমধ্যেই জন্ম নেয় লোভ, হিংসার মতো ষড়রিপু। এতো জানা কথা। আর তাই তো সে সাধারণ।
উত্তর কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে বর্তমানে তরুণ নাট্যকার ও অভিনেতা কৌশিক করের পরিচালনায় ‘রঙ্গ’ গত ২৯ শে জুলাই মঞ্চস্থ করে বিশ্বরূপম নাটকটি। ঘরে-বাইরে নানান চাপে অতিষ্ঠ অর্জুন ( নাটকের চরিত্র)ও সেই মোহ, মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। তার মনে হয়েছে সে হেরে গিয়েছে আত্মীয়, অনাত্মীয়ের কাছে। তাই সে নিজেকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু জোরে মেঘ ডাকলে সে থমকে যায়। এটাই তো স্বাভাবিক।

আর এখান থেকে তাঁর জীবনের বাঁক বদলে যায়। শুরু হয় আত্মদর্শনের পাঠ। কৃষ্ণরূপী কৌশিক গীতার বাণী তাঁর সহভিনেতা শান্তনু নাথ ( নাটকের অর্জুন চরিত্র)কে বোঝাতে থাকে নানানভাবে। অর্জুনও নিজেকে খুঁজে পায়। নিজেকে হত্যার বদলে সে নিজেকে রিস্টার্ট করতে শেখে। দিন কয়েক আগে গীতার বাণীকে অবলম্বন করে প্যারিসে চলা অলিম্পিক্সে ইতিহাস গড়েছে মনু ভাকর, সে কথা আজ বিশ্ব জেনেছে।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না গিরিশ স্মরণ। প্রবাদ প্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ ঘোষকে ডিজিটালও যুগও প্রিজার্ভ করে। সেই গিরিশ ঘোষ যিনি তাঁর নাটকের অভিনয় শুরুই করেছিলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। তখনও তিনি রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাননি। প্রথম জীবনে গিরিশের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ছিল না। পরবর্তী সময়ে গিরিশ রচিত ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সেতু বন্ধনের কাজ করেছিল। আর সেই সাক্ষাৎই বদলে দিয়েছিল গিরিশকে।

প্রসঙ্গত, এই মিনার্ভা থিয়েটারেই মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক। সেই নাটক ছিল কৌশিকের প্রতিভার সাক্ষর। কৌশিক তারপর হেঁটে এসেছে আরও কয়েকশো মাইল। চলার পথে ব্যধের ছোড়া তীর তাঁর কখনও পায়ে লেগেছে। কখনও বিঁধেছে বুকে। কৌশিক রক্তাক্ত হয়েছে। যন্ত্রণায় কাতর হয়েছে। ব্যথা ঠেলে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। একনজরে হয়ত গতি শ্লথ হয়েছে। কিন্তু মন শক্ত হয়েছে কৌশিকের। সেই পথ চলার অভিজ্ঞতাই ‘বিশ্বরূপম’ নাটকে তুলে ধরে মৌলিক নাটকের ছাপ রাখার চেষ্টা করেছে সে। শান্তনুও তাঁর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে কৌশিককে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।

তবে আলোচিত নাটককে বিনোদনের ব্যকরণে ফেললে দেখা যাবে মঞ্চে সেদিন আলো চলেছিল আপন খেয়ালে। কৌশিকের টানা সংলাপ মাঝেমধ্যেই একঘেঁয়ে লেগেছে। খেই হারিয়ে যায় দু-একবার। দুটি চরিত্রের প্রায় ঘন্টা দেড়েকের এই ধরনের উচ্চদর্শনের নাটকের সংলাপের মাঝে দু-চারবার বিরতি নিলে দর্শক আরও মনোনিবেশ করতে পারবে বলেই মনে হয়।