তালিকায় নাম তুলতে আধার এড়ানোর পরামর্শ মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের, কর্মীরা অপারগ

Social Share

সংবাদ হাজারদুয়ারি ওয়েবডেস্কঃ নকল আধার কার্ড যে তৈরি হচ্ছে সে খবর জেলা প্রশাসনের কাছে আগেই ছিল। চলতি বছর পুজোর পরে মুর্শিদাবাদে বুথ লেভেল আধিকারিকদের যে প্রশিক্ষণ হয়েছে সেখানে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য আধারকে এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। তখনও অবশ্য নকল পাসপোর্ট কিংবা আধার তৈরি চক্রের যোগ প্রকাশ্যে আসেনি বাংলায়। কিন্তু মাঠে নেমে কাজ করতে গিয়ে বুথ লেভেল আধিকারিকরা (BLO) আধার ছাড়া নাম তুলতে গিয়ে চোখে আঁধার দেখছেন বলে দাবি।

ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য জন্মের শংসাপত্র, বাসস্থানের প্রমাণ পত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্রের প্রয়োজন হয়। আর সেখানে অনেকেই আধার কার্ড দেখিয়েও তালিকায় নাম তোলেন। ভোটার তালিকায় নাম তোলার সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির দাবি, আধার কার্ডকে সরাসরি নথি হিসেবে গুরুত্বও দেওয়া হয়নি আবার বাতিলও বলা হয়নি। মুর্শিদাবাদ জেলার নির্বাচন দফতরের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক লিটন সাহা বলেন, “আধার কার্ড কখনোই ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য অপরিহার্য নয়।” বিকল্প নথি হিসেবে তিনি রেশন কার্ড বা প্যান কার্ডের কথা বলেন।

কিন্ত বিএলও-দের দাবি, জন্মের শংসাপত্র মিললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসস্থানের প্রমাণপত্র হিসেবে মানুষজন কোনও নথি দিতে পারছেন না একমাত্র আধার ছাড়া। সেই প্রমাণপত্র দিতে পারেন এলাকার জন প্রতিনিধি কিংবা তালিকাভুক্ত সরকারি কোনও আধিকারিক। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই শংসাপত্র জোগাড় করতে না পেরে তালিকায় নাম নথিভুক্ত করতে এসে আধারকেই বেছে নেন ভোটাররা। ভোটার তালিকা সংশোধন বা পরিমার্জনের কাজে যুক্ত কর্মীদের একদিকে সময়ে কাজ শেষ করা অন্যদিকে বাধ্যতামূলকভাবে নাম ভোটার তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক সময় বাধ্য হয়ে নথি হিসেবে জুড়তে হয় আধারকে। অনেকেই প্যান (PAN) কার্ডকে ব্যাঙ্কের বাইরে আনতে চান না। তখন তারা একপ্রকার জোর করেন আধারকে প্রামাণ্য নথি হিসেবে দেখাতে। একদম অগ্রাহ্য না করার পরামর্শ থাকায় ওই কর্মীও তখন আধারকে গ্রহণ করতে বাধ্য হন।

আবার জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রেও বাসস্থানের শংসাপত্র দেওয়ায় ভরসা আধারই। আধার নকল না আসল তা যাচাই করার রাস্তা না থাকায় ছাপানো প্যাডে যিনি বাসস্থানের প্রমাণ হিসেবে জনপ্রতিনিধির কাছে শংসাপত্র নিতে গিয়েছেন তাঁর কাছেই নাম ঠিকানা লিখে আধারের সঙ্গে তা মিলিয়ে নিয়ে সেই শংসাপত্র দেওয়া হয় বলে জানান বহরমপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আইজুদ্দিন মন্ডল।

এক বিএলও বলেন, “আধার নিয়ে কড়াকড়ি হলে অনেকের নামই তোলা যাবে না ভোটার তালিকায়।” তার দাবি, ” মানুষ আধারকেই তার সমস্ত পরিচয়ের ঠিকানা বলে মান্যতা দিয়েছে। তার কারণ সরকার সব ক্ষেত্রেই আধারকে গুরুত্ব দিয়েছে ইউনিক নম্বর হিসেবে। কিন্তু তাও জাল হওয়ায় এখন সবাই ভাবতে বসছেন ।”

এলাকার পরিচিত মুখ যিনি সাধারণত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত তাঁদেরকেই বিএলও-র দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের পক্ষেও এলাকার সব মানুষকে চিনে রাখা সম্ভব? প্রশ্ন মুর্শিদাবাদের বহরমপুর লাগোয়া এক গ্রামে কাজ করতে যাওয়া এক বিএলও-র। তাঁর অভিজ্ঞতা, ” ওই এলাকার মানুষ সচেতন নন। শেষ বেলায় এসে তাড়াহুড়ো করে নাম তুলতে আসেন। সব নথি থাকে না। কে কবে কোথা থেকে এসেছেন তা জানা কী সম্ভব ? সেই সময় আধার কার্ড বাধ্য হয়ে জুড়তে হয় নথি হিসেবে। কিন্তু তা আসল না নকল বুঝব কী করে।”

এক ব্যক্তির ভোটার তালিকায় দুই জায়গায় নাম রয়েছে। সেই ব্যক্তির সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের যোগ রয়েছে। আর তা নিয়ে চর্চায় দেশ। তাদের হদিশ দিয়েছে অসম পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। সংবাদে প্রকাশ, এখনও পর্যন্ত এগারো জন এবিটি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আসাম পুলিশ।

সম্প্রতি পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ও নির্বাচন কমিশনে লিখিত ভাবে তথ্য তুলে ধরে সত্য উদঘাটনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ওই আবেদন পত্রে নির্দিষ্ট এপিক (EPIC: Election photo identity card) নম্বর তুলে জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, LPZ2746576 নম্বরের একটি ভোটার কার্ড দেশের দুই প্রান্তের দুই বাসিন্দার নামে নথিভুক্ত।

তার একটি ভোটার কার্ড রয়েছে বাংলার বাসিন্দা সাহিন আলমের নামে। তাঁর বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরে। সেই একই নম্বরে আরও একটি ভোটার কার্ড রয়েছে আয়ুব খানের। তিনি গুজরাটের আহমেদাবাদের বাসিন্দা। শুধু একটি নয়, ভোটার কার্ড নম্বর LPZ2746790-তেও গলদ। ওই নম্বরের একজন গুজরাটের জিগনেশ মাকভানা। আর একজন দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর এলাকার তসলিমা মিঞা।

কেরল থেকে সাদ রাদি ওরফে শাব শেখ নামে বাংলাদেশের রাজশাহির এক বাসিন্দাকে গ্রেফতার করার পর পুলিশ জানতে পেরেছে মুর্শিদাবাদের দুই বিধানসভা হরিহরপাড়া ও নওদার ভোটার তালিকায় তার নাম আছে। ইতিমধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার নাম বাদ দেওয়া কথা জানানো হয়েছে। তেমনি ওই কাজের সঙ্গে জড়িতেদের কারণ দর্শনোর চিঠিও পাঠানো হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়। আর এখানেই প্রশ্ন তুলছেন পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সভাপতি মহঃ রিপন। তাঁর প্রশ্ন, ” যাঁরা বিএলও আছেন তাঁরা আধার কার্ড, ভোটার কার্ড যাচাই করেন। আধার কার্ডের সঙ্গে লিঙ্ক করা হয় ভোটার কার্ডের। তবু কী করে এই সব কাজ হয়?”

কিন্তু বিএলও-বা আধার নম্বর যাচাই করবেন কীভাবে? এইসব জটিলতার মধ্যে কারসাজির গন্ধ পাচ্ছেন রিপন। শুধু তাই নয়, তাঁর অভিযোগ, বাংলাদেশের ঘরে অশান্তির জের ও জাল নথি তৈরির চক্র প্রকাশ্যে আসার পর ভোটার কার্ড দেখানো সত্ত্বেও ভিন রাজ্যে বাঙালি হিসেবে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের। প্রসঙ্গত, বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ অধীর চৌধুরী এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন। এদিন রিপনও অনুযোগের সুরে বলেন, ” এসব কিছুই হচ্ছে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights