
বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ একজন শিল্পীর চাহিদা কী? বিশেষ করে তা যদি হয় পারফর্মিং আর্টের সঙ্গে জড়িত কেউ। তাহলে সেই মঞ্চশিল্পী নিজের মুক্তি খোঁজেন মঞ্চের আলোয়, আলোয়। নিজেকে মঞ্চের উপযোগী করে, আবেগ নিয়ন্ত্রিত অভিনয় দিয়ে তিনি জয় করে নিতে চান দর্শক মন। যখনই সেখানে ছেদ পরে, ছটফট করে তাঁর প্রাণ। প্রসন্নর ও এক অবস্থা।
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যখন তাঁকে যাত্রার মঞ্চ থেকে বহু দূরে অবস্থান করতে হয় একপ্রকার বাধ্য হয়ে, যখন তাঁর জীবনে নেমে আসে অযাচিত অন্ধকার, তাকে পাগল বলে দাগিয়ে দেয় একশ্রেণির ষড়যন্ত্রকারী, এলোমেলো হয়ে যায় সংসার, সংগ্রাম করতে হয় একসময়ের অর্থ, যশ উপার্জন করা মঞ্চের ‘রাজা’কে, তাঁর সেই বেদনা বোঝে ক’জন বিশ্ব সংসারে ? তবুও সুযোগ আসে, যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল সেই দেওয়ালে ভর করেই প্রসন্ন আবার ফিরে আসে যাত্রাভিনয়ে, অন্য রূপে, অন্য ভূমিকায়। বিশ্বাস হারানো পাপ, স্বপ্নের সওদাগরকে বোঝাতে হয় আপনজনদের। ফেরে প্রাণ।
উৎসবের আলো যখন নিভু নিভু হয়ে আসে বহরমপুরে তখন জ্বলে ওঠে মঞ্চের আলো। শুরু হয় নানান দলের নাটকের উৎসব। ২০২৪ ও তার ব্যতিক্রম নয়। নভেম্বরের শুরুতেই ‘সহসা’ নাট্যসংস্থা চলতি বছরের নাটকের উৎসবের সূচনা করেছে তাদের সাহস উৎসব-২০২৪ এর মধ্য দিয়ে। তার পিছু পিছু রবিবার থেকে শুরু হল যুগাগ্নির ‘বঙ্গরঙ্গ মিলন মেলা’। সেখানেই মঞ্চস্থ হল “নির্বাক অভিনয় একাডেমী” প্রযোজিত অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক “সওদাগরের নৌকা”। এর আগে যুগাগ্নি খোলা মাঠে আয়োজন করত “লোকনাট্য ও নগর নাট্যের মিলন মেলা।” মেলা জুড়ে থাকত লোক সংস্কৃতির নানান উপকরণ ।

ছয়- সাতের দশকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন তাঁর মৌলিক নাটক “সওদাগরের নৌকা (নওকা!)”। ‘চাঁদ বণিকের পালা’র মতো যা বাংলা থিয়েটারে এক মাইলস্টোন হয়ে আছে। নাটক রচনা হওয়া ইস্তক থিয়েটারের ‘রাজা’রা এই নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। অভিনয় করেছেন বাঘা বাঘা শিল্পীরা। অভিনেতারা সকলেই প্রসন্ন হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ও এই ধ্রুপদী নাটককে মঞ্চে হাজির করেছেন নিজস্ব ঢঙে। দেবশঙ্কর হালদার, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, সুজন মুখোপাধ্যায়রা সেই নাটকে অভিনয় করেছেন প্রশংসনীয়।
“নির্বাক অভিনয় একাডেমী” প্রযোজিত অশোক মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত এই নাটকেও সৌমিত্র বসু, সুরঞ্জনা দাশগুপ্তের মতো নামজাদা শিল্পীরাও নিজেদের সেরাটা দিয়ে প্রসন্ন হয়ে উঠতে চেয়েছেন। কিন্তু ২০২৪-র শেষে এসে “নির্বাক অভিনয় একাডেমী” যখন এই নাটক একাধিকবার মঞ্চস্থ করছেন রাজ্যের একাধিক মঞ্চে তখন প্রশ্ন জাগে কোন ধরনের দর্শক এখন এই নাটক দেখতে আগ্রহী ? না কি নাটকের নতুন ভাষ্য নেই, তাই প্রাচীনকে আঁকড়ে থিয়েটারের সওদাগরদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতেই এখনও এই নাটক মঞ্চস্থ করতে হয়?
দিন বদলেছে থিয়েটারেরও। বিশেষ করে, করোনার ধাক্কায় বিবর্ণ হয়েছে থিয়েটারের রঙ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে দর্শক। নতুন প্রজন্ম মুখ গুঁজেছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। ফর্ম ভেঙে ফর্ম গড়ে শো কিন্তু চলেছে ধাক্কা খেতে খেতে। ইউটিউব আর ফেসবুকে মুখ গুঁজে থাকা জেনারেশন ওয়াই ও এসেছে নাটকের মঞ্চে। পিছু পিছু জেনারেশন জে। তবে সেখানে প্রসন্ন’র মতো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রাণ মিলেছে কি না তা নিয়ে তর্ক আছে। নিরন্তর মোবাইল ঘাঁটা এই নয়া প্রজন্মের মধ্যে টানা দু-ঘন্টার নাটক দেখার ধৈর্য্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। যদিও নাটক শেষে সৌমিত্র বসু বলছেন, ” সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে, আর তারা আছে বলেই তো আমরা প্রত্যেক শো-এর পরে প্রশংসা শুনতে পাই।”

যুগাগ্নি অবশ্য এই জেনারেশনকে এই ধরনের ক্লাসিক নাটক দেখাতেই আগ্রহী, জানালেন পরিচালক দেবাশিস সান্যাল। তিনি বলেন, ” অভিনয় সমৃদ্ধ নাটক যত বেশি নতুন ছেলেমেয়েরা দেখবে তত তারা থিয়েটারের আসল মজাটা ধরতে পারবে। বুঝতে পারবে চটকদারিতাই থিয়েটারের সব নয়।”
‘সহসা’র নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিন মঞ্চস্থ হয় এই সময়ের সাড়া ফেলা (?) নাটক “চন্দ্রাহতের কুটির”। রবিশঙ্কর বলের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সেই নাটকও অভিনিত হয় দু-ঘন্টা দশ মিনিট ধরে। যথেষ্ট কড়া পাকের হওয়া সত্বেও সংস্থার নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নাটকটি কলকাতায় গিয়ে দেখে এসে জানিয়েছিল বহরমপুরবাসীকে এই নাটক দেখানো হোক। সেবার দর্শকাসনে লোক ছিল না বললেই চলে। যা ছিল তাতে সংস্থার ছেলেমেয়েরাই ছিল সংখ্যায় বেশি।
সহসা’র কর্ণধার সন্দীপ বাগচী অবশ্য দর্শকাসনে জেনারেশন ওয়াই বা জে’র অনুপস্থিতিকে আর্থ সামাজিক অবস্থার নিরিখেই দেখতে চান। তিনি বলেন, ” সামগ্রীকভাবেই সমাজ বদলে গিয়েছে। এখন সে যুগের যাত্রাশিল্পীদের মতো ভাবতে গেলে বিশেষ করে মফঃস্বলের ছেলেমেয়েদের না খেতে পেয়ে মরতে হবে।” একইসঙ্গে তাঁর আরও দাবি, ” নতুন প্রজন্ম এখন আর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নাটকের কথাও শুনতে আগ্রহী নয়। তারা অনেক সাহসী। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলায় স্বচ্ছন্দ।”
আর এই প্রশ্ন, প্রতি প্রশ্ন, দেখা না দেখাতেই হয়ত আবার এগিয়ে যাবে থিয়েটার। ফিরবে থিয়েটারের সোনালি দিন দাবি থিয়েটারের হাল ধরে রাখা চালকদের।
Lovely!