” অরুণ দা’র  চলে যাওয়াটা আমার কাছে এক্কেবারে মনাইছে না রে “

Social Share
বহরমপুরে নাইয়া’র ডাকে সাড়া দিয়ে গান গাইতে এসেছিলেন অরুণ কুমার চক্রবর্তী (বামদিকে)

শুক্রবার বিকেলে মোহরকুঞ্জে জঙ্গল মহল উৎসবে পদযাত্রা করেছেন, বৃক্ষরোপণ করেছেন। তাঁরই লেখা গানে শিল্পীর কন্ঠের সুরে হাতে তালি দিয়ে মঞ্চে নেচেছেন। যথারিতি কলকাতা থেকে সুদূর চন্দননগরের বাড়ি ফিরেছেন। রাতের খাওয়া সেরে শুয়েছেন। সকালে ভোরের দিকে বাথরুমে যেতে গিয়ে পড়ে যান।  মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় প্রাণচঞ্চল এই মানুষটির জীবন।

একমুখ দাড়ি নিয়ে চলা মাথায় ফেট্টি জড়ানো মানুষটি আর কোনওদিন জঙ্গলমহল, আদিবাসী, প্রকৃতিকে নিয়ে আর কবিতা লিখবেন না। শিশু থেকে বৃদ্ধ যার সঙ্গে দেখা হতো পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করা আনা চকোলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন “কেমন আছ?”

নাইয়ার আমন্ত্রণে বহরমপুরে এসে মঞ্চ থেকে দর্শকদের উদ্দেশ্যে মুঠো মুঠো চকোলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেটা ২০১৮ সালের কথা। মঞ্চে উঠে গান করলেন “ লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা।“ নিজের লেখা কবিতাও পাঠ করলেন রবীন্দ্রসদনের মঞ্চ থেকে।

সেই কবিতাটি ছিল- “রবি ঠাকুর হে, ই বোশেখে তুকে গেরামে লিয়ে যাব।”সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে নাইয়া মঞ্চস্থ করেছিল ঝুমুরের গান। আর সেই গান শুনে খুশি হয়েছিলেন অরুণ দা। ফিরে গিয়ে আমাকে ফোন করে একটি কবিতা পাঠিয়ে বললেন সুর দিতে। গানটি চারবার গেয়ে ওঁকে পাঠিয়েছিলাম। চারবারই বাতিল করেছিলেন। পরে ফোনে ধমক দিয়ে বললেন, “মাটির কাছে নেমে এসো। নিজেকে আদিবাসীদের মতো ভাব। তাঁদের সংস্কৃতি ভেবে দেখো। তবেই পারবে তাদের ভাষায় গান গাইতে। শহরে থেকে ঝুমুর গান গাওয়া যায় না। মাটির কাছে নেমে আসতে হয়।“

আমিও তাঁকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম উচ্চারণটা কেমন হবে ? তাঁর পরামর্শমতো গানটি প্রস্তুত করেছিলাম। উনি নিজেই সেই গান পরে প্রচার করেছিলেন খুশি হয়ে।  

২০২২ সালে নাইয়া ও সৃষ্টিসুখের শিল্পী, লোকশিল্পী অমিত গুহ, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় আর অঞ্জন গোস্বামী মিলে আমরা মঞ্চস্থ করি ৫০ কন্ঠে “লাল পাহাড়ীর দ্যাশে যা” গানটি। সেদিনও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তিনি। ওই বছরই গানটির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা এই গানটি গেয়েছিলাম।

সেদিন খুব দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন- “ আজকালকার শিল্পীরা গানটি না বুঝেই গাইছে। কেবলমাত্র ঊষা উত্থুপ এবং বাউল বলাই সরকার গানটি যথাযথ গেয়েছেন। নাগর ও নাগর কথাটি আমার গানে কখনোই ব্যবহার করিনি। আর শুরুতে “তু ইখানে ক্যানে” এই কথাটিও কেউ ব্যবহার করে না। না জেনে, না পড়ে, না বুঝে সবাই আজকাল লোকগান গাইছে।“

ইতালির মানুষজন তাঁদের ভাষায় এই গানটি গেয়েছেন     “ রোচ্ছো মন তানিয়া পায়াছো ভিয়া রোচ্ছো তেররা পায়াছো ভিয়া, ননসে তে বিল্লো নিয়ান্তে। ননছেতে বেল্ল নিয়ান্তে” বাংলায় তরজা করলে দাঁড়ায় “ লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা/ রাঙা মাটির দ্যাশে যা ইথাক তোকে মনাইছে না রে।“

বহরমপুরে অনেক শিল্পীই এসেছেন আমাদের ডাকে। একথা বলতে দ্বিধা নেই, তাঁদের অনেককেই হোটেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় কিংবা খাবার পাঠিয়ে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের ডাকে বহরমপুরে গান গাইতে এসে অরুণ দা আমাদের সঙ্গে রাতের বেলায় গাছ তলাতে বসে খাওয়া দাওয়া করেছেন। খুব কাছ থেকে এই মানুষটিকে দেখেছি। মাটির কাছে থাকা একজন মানুষ। যিনি রূপোর থালার থেকে শাল পাতায় খেতে পছন্দ করেন। সহজ সরল মানুষ ছিলেন অরুণ দা।

একটা কবিতা ফোনে পাঠিয়ে বলেছিলেন সুর দিয়ে গানটি কোরো। সেই গান তৈরি হল কিন্তু তাঁকে শোনাতে পারলাম না। আজকে তিনি লাল  পাহাড়ের মাথায় বসে আছেন সাধের রাঙা মাটির পথ চেয়ে। তাঁর চলে যাওয়াটা আমার কাছে এক্কেবারে মনাইছে না রে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights