বিদ্যুৎ মৈত্র, মুর্শিদাবাদঃ দলীয় রাজনীতির বাইরে বেড়িয়ে সমাজের একাংশ মহিলা নিজেদের নিরাপত্তা ও আরজিকর হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুন কান্ডের প্রতিবাদে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করছেন। রাজ্যের একাধিক জায়গার মতো বহরমপুরেও ১৪ অগস্ট ওই মহিলারা ” মেয়েদের রাত দখল” কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু ওই অদলীয় কর্মসূচিতে জট পাকানোর অভিযোগ উঠল বিজেপির বিরুদ্ধে। বহরমপুরের কর্মসূচির উদ্যোগী মহিলাদের একজনকে মারের হুমকি দিলেন এক জেলা বিজেপি নেত্রী। যা বিতর্ক তৈরি করল বহরমপুরে।
১৪ অগস্ট “রাত দখলের” কর্মসূচিতে বহরমপুরের সেদিনের জনস্রোতে মিশে যায় বিজেপি, সিপিএম, এসইউসিআইয়ের মতো রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মীরা। এমনটাই পর্যবেক্ষণ জমায়েতে অংশ নেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের। সেই পর্যবেক্ষণ স্বীকার করছেন উদ্যোক্তারাও। এক উদ্যোক্তা সোনালী গুপ্ত বলেন, “ যেমন বিজেপি, তেমনই সিপিএম, এসইউসিআই এই জমায়েতে দলীয় রাজনীতির রঙ লাগানোর চক্রান্ত করেছে। আর একে সিপিএমের উদ্যোগ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে একাংশ। আমরা এর ভীষণ বিরোধী। আর সেই কারণেই বোধহয় বিজেপির রাগ হচ্ছে, তাই মারার হুমকি দিচ্ছে। যদিও শেষপর্যন্ত তা কেউই পারেনি।“

অভিযোগ, সেদিনের জমায়েতে প্রথমে শঙ্খ বাজিয়ে বিতর্ক তৈরি করে বিজেপি। বেশ খানিকক্ষণ দু-পক্ষের মধ্যে শঙ্খ বাজানোকে কেন্দ্র করে বচসাও হয়। যদিও জনতার জমায়েতে সেই বিতর্ক বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরবর্তী সময়টুকুতে তা নিয়ে কোনও সমস্যা না হলেও সমস্যা হয় আজ রবিবার।
বহরমপুরে আগামীকাল রাখী দিবস উপলক্ষে রাত আটটায় ফের জমায়েতের ডাক দিয়েছেন সেদিনের কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকা মহিলারা। ওই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য ফোনে আমন্ত্রণ জানাতে “ ফোন কল লিস্ট” দেখে ফোন করছিলেন কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা দিশারী মালাকার। তাঁর ‘ফোন কল লিস্ট’এ ছিল বিজেপি’র জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য অনামিকা ঘোষের নামও। অভিযোগ, ওই বিজেপি নেত্রী আমন্ত্রণ পেয়ে দিশারীকে মারের হুমকি দেন।
পেশায় স্কুল শিক্ষিকা ও নাট্যকর্মী দিশারী বলেন, “আমাকে ওই নেত্রী বলেন, যদিও তিনি বিজেপি করেন না কি সিপিএম করেন কিংবা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত তা আমি জানতাম না। আমি ওঁকে রাখীবন্ধনের কর্মসূচির কথা জানানোয় উনি আমাকে বলেন আপনারা সিপিএমের লোকজন ওখানে অরাজনীতির নামে রাজনীতি করছেন। আমরা সব দেখেছি। এরপর আপনি মার খাবেন।” বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক অনামিকা অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে সেদিন যে বিজেপি ওই অদলীয় কর্মকান্ডকে পক্ষে টানতে জমায়েতে গিয়েছিল তা ঘুরিয়ে স্বীকার করেছেন বিজেপির ওই মহিলা কার্যকর্তা।
তিনি বলেন, “ওই ফোন নম্বরে ফোন করে জমায়েতে অংশ নেওয়ার কথা বলায় আমাকে সেখানে যেতে বারণ করা হয়েছিল। যখন যাই তখন আমার হাত থেকে শাঁখ কেড়ে নেওয়া হয়। ধাক্কা ধাক্কি দেওয়া হয়। আমরা সেদিনই এটাকে বড় ইস্যু করতে পারিতাম কিন্তু তা করিনি। ওই জমায়েতে আজাদি শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় পতাকা নিয়ে যাওয়াতে ও ওদের সমস্যা। সেখানে দেশবিরোধী কথা হয়েছিল আমি সেগুলিই বলেছিলাম। কিন্তু আমি মারবার কথা বলিনি। ওরা রঙচঙ মাখিয়ে ফুটেজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।”

সোনালি বলেন, “ একসময় অ্যালার্ট করার জন্য শাঁখ বাজানো হত। এখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ধর্মীয় ভাবাবেগ তুলে শাঁখকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু আমাদের উদ্দ্যেশ্য পরিস্কার। আমরা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছি। কোনও দলীয় রাজনীতিকে এই জমায়েতে আহ্বান করা হয়নি। তাই শাঁখ বাজানোয় আপত্তি ছিল কিন্তু জাতীয় পতাকা নিয়ে যাওয়ায় আমাদের কোনও আপত্তি ছিল না।”
বিজেপির জেলা সভাপতি শাখারভ সরকার বলেন, “কে এই ধরনের কথা বলেছে জানি না। আমাদের দল এই ধরনের হিংসাত্মক শব্দ প্রয়োগ বা কাজকর্মের তীব্র বিরোধী। কেউ যদি একথা বলে থাকে দলের নাম করে তাহলে তার দায় দলের নয় ওই ব্যক্তির।“ তবে শাখারভও ওই জমায়েতে শাঁখ না বাজানোর নিদানের বিরোধীতা করেন।
প্রসঙ্গত, ১৬ অগস্ট বিজেপির জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েও দলের অন্দরে অনামিকা বিতর্ক তৈরি করেছেন বলে বিজেপি সূত্রে খবর। সেদিন পুলিশের গাড়ির বনেটে উঠে একটা দীর্ঘ সময় দলীয় পতাকা ওড়াতে থাকেন ওই বিজেপি নেত্রী। যা দল সমর্থন করেনি বলে দাবি সূত্রের। শাখারভও বলেন, “আমরা এই ধরনের কর্মকান্ডের বিরোধী। যাঁরা করেন তাঁরা সস্তার প্রচার পেতে এসব কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম করেন।” অনামিকা বলেন, “ পুলিশের গাড়িটা আমাদের একে ওকে তাকে ধাক্কা দিচ্ছিল তাই থামাতে গাড়ির বনেটে উঠেছিলাম।”
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সন্দীপন দাস বলেন, ” সেদিনের জমায়েতের ক্রেডিট সোনালী গুপ্তরা একা নিতে পারেন না। ১৪ অগস্ট রাতে মানুষের স্বতস্ফূর্ত জমায়েত ছিল। সেখানে সোনালী গুপ্ত না থাকলেও মানুষ থাকত। মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা দলীয় পতাকা ব্যবহার করিনি। বড় মশাল মিছিল নিয়ে ওই জমায়েতে প্রবেশ করেছিলাম পতাকা ছাড়াই।” এসইউসিআই নেতা কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ” কে কার কাছে কী দখল করবে? একটা প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সব্বার জমায়েত ছিল। আমরা ছেলেরা দূরে ছিলাম পতাকা ছাড়া। দলের মেয়েরাও পতাকা নিয়ে ওদের পাশে দাঁড়ায়নি। যাঁরা বলছেন তাঁরা কেন বলছেন জানি না।”