
সন্দীপন মজুমদারঃ বহরমপুর কালেক্টরেট ক্লাবের অডিটোরিয়ামে ৫ই মার্চ শুরু হল এই শহরের একদল চলচ্চিত্রপ্রেমী তরুণ তরুণীর উদ্যোগে চলচ্চিত্রচর্চার ব্যানারে ছোট্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল। এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। মাঝে কোভিডের জন্য বছর দুয়েক বন্ধ থাকলেও এই বছর যে তা আবার আয়োজিত হচ্ছে সেটা বহরমপুর তথা গোটা জেলার ফিল্মচর্চায় আগ্রহী মানুষের কাছে এক বাড়তি পাওনা।
এই বছর ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্ম শতবর্ষ। ঋত্বিকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে এই উৎসবের ছবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আশ্চর্য রকমের বিবেচনাবোধ দেখিয়েছেন আয়োজকরা। উদ্যোক্তাদের তরফে সায়ন্তন সেন জানালেন যে শুধু ঋত্বিক ঘটকের ছবিই নয়, তাঁর প্রিয় পরিচালক বুনুয়েল এবং মিজোগুচি, তাঁর প্রিয় ছাত্র ( পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ) কুমার সাহানী এবং জন আব্রাহামের ছবিও দেখাচ্ছেন তাঁরা। উৎসবের উদবোধন করলেন এই শহরের একদা অধিবাসী ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবির সূত্রে বহুল পরিচিত পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে প্রদীপ্তর সাম্প্রতিক ছবি ‘ নধরের ভেলা’ রটারডাম চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে।
প্রথম দিন উৎসব প্রাঙ্গনে খোলা প্রাঙ্গনেই প্রদর্শিত হল ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘আমার লেনিন ‘ । ১৯৭০ সালে লেনিনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নির্মিত হয়েছিল ছবিটি। একজন সাধারণ গ্রামীণ কৃষকের সংগ্রামী চেতনায় কীভাবে লেনিন সাড়া ফেলেন, কীভাবে জমির লড়াইয়ের গণচেতনায় অনুপ্রেরণা জোগান লেনিন—সেই নিয়েই এই ছবি। আবেগের আতিশয্য থাকলেও এই ছবির নির্মাণ থেকে এখনও অনেক কিছু শেখার আছে , বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষাকে শিল্পের কাঠামোয় ধরার সমস্যা নিয়ে যাঁরা ভাবিত তাঁদের ক্ষেত্রে।
অডিটোরিয়ামে প্রথম যে ছবিটি দেখানো হল সেটি প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য পরিচালিত একটি তথ্যচিত্র
‘শিকড়’। এক ঘন্টা ছয় মিনিটের এই ছবিতে প্রদীপ্ত নিজের পরিবার, বেড়ে ওঠার পরিবেশ নদীয়ার তেহট্টের পটভূমিকায় বিন্যস্ত করেছেন। তেহট্টর ভূগোল, প্রকৃতি, নদী, মানুষ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, ধর্ম,সমন্বয়, লোকসংস্কৃতি — সবকিছু জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেলুলয়েডে । লোকসঙ্গীতের সার্বিক উপস্থিতি সুরে আর কথায় এক দার্শনিক উদাসীনতার মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে ছবির ভৌত বাস্তবতাকে। এই মায়ার শিকড়ই একজন শিল্পীকে প্রাণরসে সঞ্জীবিত রাখে।
ঋত্বিক ঘটকের শেষ ছবি ‘ যুক্তি , তক্কো আর গপ্পো’ ( ১৯৭৪) তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত ছবি। এই ছবি সিনেমার প্রচলিত ভাষাকে দুরমুশ করে পরিচালকের নিজের জীবনকেও যেভাবে শিল্পের আতসকাচের সামনে ফেলে পরীক্ষা করে তা অভূতপূর্ব। বহুল আলোচিত এই ছবি প্রসঙ্গে অনেকে উচ্ছসিত থাকেন, অনেকে কিছুটা সমালোচনার সুর বজায় রাখেন। কিন্তু কেউই ছবিটির গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষে এই ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে চলচ্চিত্র চর্চা সিনেপ্রেমীদের বাধিত করল।
দেশ বিদেশের ভালো ছবি দেখার সুযোগ এখন আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু সেসবই মূলত ইনটারনেট বা ও টি টির মত ব্যক্তিগত উপভোগের জায়গা থেকে । কিন্তু সিনেমা তো দেখেই ভুলে যাওয়ার জন্য নয়, তাকে নিয়ে ভাবার জন্য, ভাব বিনিময়ের জন্য, তর্ক করার জন্যও বটে। বরং এইভাবেই একটা ছবির নির্মাণ সার্থক হয়ে ওঠে। একটা চলচ্চিত্র উৎসব করার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। এটা জানেন বলেই উদ্যোক্তারা পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত লেখালেখি নিয়ে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন।
আগামী শনিবার ৮ ই মার্চ পর্যন্ত চলবে এই উৎসব। বিদেশি নতুন ছবি যেমন লিও কারাক্সের ‘হোলি মোটরস ‘ ( ২০১২) বা তুরস্কের পরিচালক নুরি বিলগে সেইলানের ‘ উইনটার স্লীপ (২০১৪) এই উৎসবে দেখানো হবে। দুটিই বিখ্যাত এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি। ভালো ছবি যাঁরা দেখতে চান তাঁরা নিশ্চয়ই এরকম সুযোগ হাতছাড় করতে চাইবেন না। ঋত্বিক ঘটক থেকে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য– – চলচ্চিত্রের শিল্পসুষমার অনুধ্যানের উত্তরাধিকার চলচ্চিত্রচর্চার এই সাহসী উদ্যোগের মধ্যেই ধরা রইল এই ক্রান্তিকালে।
