
সন্দীপন মজুমদারঃ এই নভেম্বর মাসে শুরু হয়ে গেল বাংলা তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক বরেণ্য পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মশতবর্ষ। বহরমপুর শহরের সঙ্গে ঘটক পরিবারের যোগসূত্রের ভিত্তিতে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে এক অন্তর্লীন সম্পর্কে বাঁধা পড়েছিল এই শহরের চলচ্চিত্রমনস্ক মানুষের মননজগৎ। তাই বুঝি এই শহরের ফিল্ম সোসাইটির প্রেক্ষাগৃহের নাম অনিবার্যভাবেই হয় ঋত্বিক সদন । এখানে উল্লেখযোগ্য, পশ্চিমবঙ্গের আর কোনো ফিল্ম সোসাইটির নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ নেই, ছিল না।
পাশাপাশি উল্লেখ করা যেতে পারে যে গত শতাব্দীর আটের দশকের মধ্যভাগে এই শহরের কিছু উৎসাহী তরুণ সম্পুর্ণ নিজেদের উদ্যোগে চলচ্চিত্র চর্চার একটি পত্রিকা বের করেছিলেন নিয়মিতভাবে। এই পত্রিকার প্রকাশ কিছুটা অনিয়মিত হলেও আড়াই বছরে মোট দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে চলচ্চিত্রর চর্চাকে নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস পত্রিকাটি করেছিল তার সমতুল্য উদাহরণ চট করে পাওয়া মুশকিল,আজও।
কোথায় ছিল এই পত্রিকার অনন্যতা ? সেটা জানার জন্য জেনে নিতে হবে সিনেমা পত্রিকা বলতে কী বোঝায় । বাণিজ্যিক ছবির এবং তাদের নায়ক নায়িকাদের খবরাখবর দেওয়ার জন্য একধরণের পত্রিকা হয় যেটা বড় পুঁজির কারখানার উৎপাদন।কিন্তু সিনেমাকে যাঁরা শুধু বিনোদনের মাধ্যম মনে করেন না, শৈল্পিক অভিব্যক্তি অথবা গণজ্ঞাপনের আধার হিসেবে দেখতে চান তাদের সিনেমাচর্চার জন্য স্বাভাবিকভাবেই অন্য ধারার পত্রিকার দরকার পড়ে। এই দায় মূলত মেটাত বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটিগুলির পত্রিকা। কিন্তু এদের প্রকাশিত পত্রিকাগুলি প্রায়ই হত ইনহাউস ম্যাগাজিন অর্থাৎ ফিল্ম ক্লাবের সদস্যদের মধ্যেই সেগুলি প্রচার পেত।
কিছু কিছু ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকা, যেমন সিনে সেন্ট্রালের চিত্রবীক্ষণ , নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির চিত্রভাষ বা আসানসোল ফিল্ম স্টাডি সেন্টারের পটভূমি লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে পাওয়া যেত বটে কিন্তু সেখানে আলোচিত ছবিগুলি সাধারণ দর্শকদের অদেখাই থাকত। এই দিক থেকে সিনেমা ভাবনা ছিল ব্যতিক্রম।
তারা জনপ্রিয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু সেই দৃষ্টি ভঙ্গী ছিল সমাজতাত্ত্বিক এবং সমালোচনামূলক। যেমন অমিতাভ বচ্চন অভিনীত অ্যাংরি ইয়ংম্যান ইমেজের উত্থানের পটভুমিকার বিশ্লেষণে সেই সময়ের গণ আন্দোলন, নকশালবাড়ির দ্রোহের পটভূমিকাকে উল্লেখ করে ছবিগুলিতে যেভাবে মানুষের সামাজিক বিক্ষোভকে ব্যক্তির বীরগাথায় পর্যবসিত করা হয়েছে সেটা একটি নিবন্ধে দেখানো হয়েছিল। সাধারণ পাঠক পড়ে বলেছেন, সত্যি, এভাবে তো আগে ভাবিনি।
অপর্ণা সেন পরিচালিত বিতর্কিত ছবি ‘পরমা’ নিয়ে সরাসরি কলেজের ছাত্রছাত্রীসমেত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে লিখিত প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক সার্ভে করেছিল এই পত্রিকা। পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সন্দীপন মজুমদার। এছাড়াও বর্তমানে প্রয়াত কৌশিক রায়চৌধুরী বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই পত্রিকায় ধ্রুব গুপ্ত, সুগত সিংহ, সুপার এইট চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা সৌমেন গুহ প্রমুখ চলচ্চিত্রবেত্তাদের লেখাও প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশেও পৌঁছাত এই পত্রিকা। এমনকি ছিন্নমূল ছবির পরিচালক , সেই সময় চেন্নাই প্রবাসী নিমাই ঘোষ পত্রিকার খোঁজ পেয়ে সাধুবাদ জানান।

আলোচিত ছবিগুলির নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই পত্রিকা একটি মাপকাঠি অনুসরণের চেষ্টা করত। সমান্তরাল ধারার যে চলচ্চিত্রগুলি এখানে আলোচিত হত লক্ষ্য রাখা হত হত যে সেগুলি বহরমপুর শহরে অন্তত প্রদর্শিত হয়েছে কিনা। সেই সময় বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে দুটি সপ্তাহ ব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসব হত— একটি বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি এবং আরেকটি সংস্কৃতি পরিষদ নামক সংগঠনের উদ্যোগে। এই দুই চলচ্চিত্র উৎসবের সৌজন্যে বেশ কিছু ভালো ছবি দেখার সুযোগ বহরমপুর তথা জেলার মানুষরা পেতেন। সেই সব ছবির আলোচনা অত্যন্ত সিরিয়াস ভঙ্গীতেই করা হত।
এছাড়া সাধারণ দর্শককে সিনেমার বিভিন্ন শৈল্পিক দিক এবং আঙ্গিক সম্পর্কে অবহিত করতে ‘সিনেমার ক্লাস’ নামে একটি বিভাগ নিয়মিত থাকত। সব মিলিয়ে সিনেমা ভাবনা এই শহরের সংস্কৃতিচর্চায় বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিল যে কারণেই বোধহয় এই পত্রিকার কথা যাঁরা জানেন তাঁরা আজও এর অভাব ব্যক্ত করে থাকেন এবং সেটা শুধু স্মৃতিমেদুরতার কারণেই নয়।

লেখক একজন নাট্যকার, সমালোচক, চিন্তক, সুবক্তাও। একজন নিবিড় পাঠক শুধু নন সন্দীপন মজুমদারের খ্যাতি তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণেও। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদকও তিনি।