বিদ্যুৎ মৈত্র, প্রতিনিধিঃ সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙারের বিখ্যাত উক্তি “পুলিশ তুমি যতোই মারো/ মাইনে তোমার একশো বারো।” আজ এই .২০২৪-এও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বেতনের ফারাক হয়ত ঘুচেছে কিন্তু আচরণ বদলায় নি। কিন্তু পুলিশ ডে-তে, কেন প্রাসঙ্গিক এই প্রশ্ন তার উত্তর পুলিশই দিতে পারবে। গত তিন চারদিন ধরে নিজেদের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নাগাড়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাক যুদ্ধে নেমে তাকে কলতলার ঝগড়ায় নামিয়েছেন যে পুলিশ আধিকারিকরা, সবিস্তারে তার কারণ ব্যখা তাদেরই করা উচিত। তাঁরাই পুলিশ ও মানুষের ফারাক গড়ছেন সমাজ মাধ্যমে। নাগরিক সমাজের অনেকের প্রশ্ন, ঘটে যাওয়া নৃশংসতা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার সুচতুর পরিকল্পনা নয়তো পুলিশের?
সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমল নেই ঠিকই। কিন্তু রাজ্যে যে আমলাতন্ত্র চলছে তা একজন কিশোর, কিশোরীও টের পায়। পুলিশ রাষ্ট্রের। পুলিশ আইনের রক্ষক। একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনীর অঙ্গ একজন ব্যক্তি। খাঁকি রঙের উর্দি তার রাষ্ট্রীয় পোশাক। তাকে পৃথকীকরণ করা যায় ওই একটিমাত্র পোশাকে। একমাত্র পুলিশ এমনকি নিচুতলার পুলিশও পারে মাথায় অশোক স্তম্ভ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। এই ক্ষমতা সমাজের আর কোন পেশায় আছে? সেই পুলিশ রাষ্ট্রের আজ্ঞাবাহক হতে গিয়ে শাসকদলের তল্পিবাহক হয়েছে। পুলিশ প্রথমে মানুষ, পরে পুলিশ। তার মধ্যেও ষড়রিপু সমানভাবে বিরাজমান। পুলিশের নামে নাগরিক সমাজের অভিযোগ কী? আইনের ফাঁক গলে অনেক প্রভাবশালী পার পেয়ে যায়, তেমনি অনেক সাধারণ মানুষকে ভুগতে হয় আইনের সাহায্য পেতে গেলে। পুলিশের বিরুদ্ধে শতকরা ৮০ শতাংশই এই অভিযোগ।
সিভিক ভলান্টিয়ার পুলিশ? এই প্রশ্ন পুলিশের নিচু তলাতেও। অথচ সে পুলিশের সমান ক্ষমতা ধরে। আরজিকর হাসপাতালে চিকিৎসক হত্যা কান্ডে সঞ্জয় রায়ের গ্রেফতারির পর সেই প্রশ্ন বেশি করে মাথা চারা দিয়েছে পুলিশ মহলে। একইভাবে শনিবার বিটি রোডে বিক্ষোভরত জনতার মাঝখানে ঢুকে পরে মদ্যপ এক সিভিক ভলান্টিয়ার। সেই ভিডিও ভাইরাল। এক্ষেত্রেও পুলিশ চাপে পরে ব্যবস্থা নেয়। যদিও এই ঘটনায় একজন সার্জেন্টের নীরব থাকায় বিক্ষোভরত জনতাকে হটানোর পুলিশি ছকবাজিই সেখানে একজন মদ্যপ সিভিক ভলান্টিয়ারের অকস্মাৎ প্রবেশ। এই দাবি বিক্ষোভরত সেই জনতার একটা বরিষ্ঠ অংশের।
স্বাভাবিকভাবেই নিরপেক্ষ নিরাপত্তা ও আইনের রক্ষক যখন নিজেই তা ভেঙে ফেলেন তখন সেই ‘নীতি পুলিশের’ বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা কি নাগরিক সমাজের অপরাধ? হোমগার্ড বা এনভিএফ পদ আর নেই। কিন্তু সেই পদের মানুষগুলোও আজকের সিভিক ভলান্টিয়ারদের মতো এত দোর্দন্ডপ্রতাপ ছিল না বলে পুলিশেরই একটি মহলের দাবি। এর দায় কার? পুলিশ কর্মীর না কি রাষ্ট্রের। গায়ে লাগবে কার? ব্যক্তি পুলিশের না কি রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র নীরব, সরব ব্যক্তি পুলিশ। কেন পুলিশ হিসেবে নিয়োগপত্র পায় না ওইসব বেরোজগেরেরা। রাষ্ট্রের করুণাই তাঁর ভবিতব্য বলে দেগে দিল কে? গায়ে লাগা উচিত কার? রাষ্ট্রের না কি পুলিশের?
এক সময় বঙ্গ পুলিশের দুটি গোষ্ঠী ছিল। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন ও নন গেজেটেড পুলিশ কর্মচারী সমিতি। একটি বাম ঘেঁষা আর একটি কংগ্রেসের। যেখানে নিচু তলার কর্মীরা নিজেদের দাবি দাওয়া, ঊর্ধতনের ন্যায় অন্যায় নিয়ে সরব হতে পারতেন। যদিও সেখানকার দেওয়ালেও নোনা ধরিয়েছিল ‘ঘুষ’। সংগঠনের নেতাদের প্রয়োজনীয় উপরি যাঁরা দিতে পারতেন তাঁদের ভাল থানায়, ভাল দফতরে পোস্টিং ছিল পাকা। নচেৎ ফাঁকা। সে দিন গিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সে সব তুলে দিয়েছে। জেলায় সব সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এখন একজন পুলিশ সুপারের হাতে। একটা সময় রাজ্যে যখন পুলিশ পদক দেওয়া শুরু হল তখন মুখ্যমন্ত্রী সেই পদক কনস্টবল থেকে আইপিএসদের হাতে তুলে দিতেন। এখন সেই কাজও পুলিশ সুপার করেন। তেমনি এখন একজন পুলিশ কর্মী অবসর নিলে তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই সেই দিনটি পুলিশ সুপার ও অন্যান্য আধিকারিকরা তা পালন করেন। সামাজিক নানান অনুষ্ঠানে যেমন পুলিশকে অংশ নিতে দেখে সাধারণ মানুষের ভয় ভাঙে তেমনি আবার শাসকদলের কর্মসূচিতে পুলিশের সক্রিয় অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষকে আশঙ্কায় রাখে বৈ কি। থানায় থানায় পুলিশ আধিকারিকদের জন্মদিনে সাধারণ মানুষ কেক কাটতে সন্ধ্যায় হাজির হন না। কিন্তু শাসকদলের স্থানীয় নেতারা ঠিক ‘ফুল বেল পাতা’ সহযোগে হাজির হয়ে যান। জন্মদিন সেলিব্রেট ও করেন। তার বেলা?
পুলিশ ঘুষ খায়, যা আজ সর্বজনবিদিত। সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনও ঘুষ খায়। কিন্তু সেটি প্রকাশ্যে আসে না। কারণ তার কোনও ইউনিফর্ম নেই। ইউনিফর্ম মানেই সে স্বতন্ত্র। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্ন নেই পুলিশের। এটাই নাগরিক সমাজের দৃষ্টিকোণ। সেই পুলিশ যখন ঢাল তলোয়ার নিয়েও উদ্যত জনতাকে সামলাতে পারে না তখন সেই পুলিশের দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। আর সেই প্রশ্নকে দূরে ঠেলে পুলিশ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বিরল গ্রহের পেশাদার মানুষ হিসেবে। যেখানে মানুষ এক প্রান্তে আর পুলিশ আর এক প্রান্তে। পুলিশের একটা অংশের এ হেন আচরণে সমাজমাধ্যমে তৈরি হয়েছে আরও এক নয়া শ্লোগান-“নিজের মেয়ের/চিন্তা ভুলে/পুলিশ খুশি/জোড়া ফুলে।”
অথচ পাহাড় কিংবা সমতলে দার্জিলিং কিংবা কলকাতায় দুষ্কৃতিদের ছোড়া গুলিতে পুলিশের প্রাণ চলে গেলে ডুকরে কেঁদে ওঠে মানুষ। আঙুল ওঠে রাষ্ট্রের দিকে। সিস্টেমের বদল চায় মানুষ। পুলিশ কোনও ব্যক্তি নয়। পুলিশ একটি রাষ্ট্রযন্ত্র। পুলিশ কোনও অমানুষ নয়। সম্পূর্ণ রক্ত-মাংসের একজন মানুষ। এই সামান্য কথাটা পুলিশের শীর্ষস্তর বুঝলে নিচুতলার পুলিশকে গাল খেতে হতো না।
অথচ খুন হয়ে যাওয়ার পরেও তার শরীরে যদি একটুও প্রাণের স্পন্দন শোনা যায় সেই নিচুতলার পুলিশই তাকে কোলে তুলে নিয়ে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে। যত দ্রুত যাওয়া যায় সেই চিন্তায় কে তখন খেয়াল রাখে নিহতের রক্তে ভিজে গিয়েছে গায়ের খাঁকি উর্দি। সেই সম্পর্কে শীতলতা নয় পুলিশ ডে-তে দাবি এক দফা এক- পুলিশ-মানুষ বিভেদ যাক। মানুষ পুলিশ উভয়েই নিরাপদে থাক। তবেই পুলিশ ডে পালনের সার্থকতা। নচেৎ…
(মতামত ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুনঃ বহরমপুরের সব ওয়ার্ডের সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়তে চান ইউসুফ