বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ আগের রাতেই পার ভেঙেছে পদ্মার। ক্রমশ এগিয়ে আসার সম্ভাবনায় রাতের ঘুম উড়েছে পদ্মাপারের গ্রাম তারানগরের বাসিন্দাদের। তার থেকেও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। রাতারাতি নিজের ঘর ছেড়ে যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যদিও কাছে গিয়ে দেখা গেল পদ্মার ভাঙা পার থেকে অন্তত পঞ্চাশ ফুট দূরে নেই কোনও বসত বাড়ি।
সেই ভাঙন দেখতে তারানগরের প্রতিবেশি রামনগর, পাহাড়পুর, বিলবোরা সহ একাধিক গ্রামের মানুষজন উজিয়ে এসেছেন সেখানে। আলগা পারে দাঁড়িয়ে কেউ তুলছেন সেলফি। কেউ বা কৌতূহলে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখতে চেয়েছেন আরও কত গভীরে আছে ক্ষত। টোটো চালক সামিম আখতার ওই এলাকায় নিয়ে যেতে যেতে বললেন, “মানুষ দেখতে আসছে। আমরাও নিয়ে আসছি। দু-পয়সা রোজগারও হচ্ছে।”এই সুযোগে পদ্মার জলে জাল ফেলে মাছও ধরছেন মানুষজন।
পদ্মার পার ঘেঁসে তারানগর গ্রামে রয়েছে বিঘের পর বিঘে আবাদি জমি। মাঠে মাঠে ফুল কপির চাষ। কোথাও ফসল পাকার মুখে।কোনওটায় ধরেছে কুঁড়ি। গত একমাস ধরে একটু একটু করে পারের মাটি আলগা হয়েছে। দিন কয়েক আগে সেই মাটি খসিয়ে তা গর্ভে নিয়েছে পদ্মা। তলিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক বিঘা জমি। ফসলের খরচ জোগানও যেখানে কষ্টকর সেখানে এই ক্ষতি পোষাবে কে? তবু রক্ষে, কারও ঘর-দুয়োর এখনও নদী গ্রাস করতে পারেনি, বলছিলেন ক্ষতিগ্রস্থরা।
তারানগরের সেই ভাঙা পারে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় জল আর জল। তার আর পার নেই কোনও। ওপার বাংলাকেও মনে হয় কতদূর। অথচ যখন জল শুকিয়ে চর পড়েছিল পদ্মায়, সেই সময় কত কাছের ছিল বাংলাদেশ। সেই চর ছিল উর্বর একখন্ড জমি। সেখানে ফসলও ফলেছিল বারমাস। তারপর কেটে গিয়েছে কতগুলো বছর। দিন কাল বদলেছে। পদ্মাও এগিয়ে এসেছে যখন যেমন পরিস্থিতি এসেছে। নিজের জমি নিড়াতে নিড়াতে জিয়াউল হক বলছিলেন সেসব। বললেন, ” আমরা ছোট বেলায় যেখানে খেলাধুলো করতাম সেসব কোথায় চলে গেল।” সেই পদ্মাই এবার এপার বাংলার পাঁচশো বিঘে (কেউ কেউ বলছেন তারও বেশি) জমি গিলেছে। ফরাক্কা ব্যারেজকে এর জন্য দোষারোপ করেছেন ওই এলাকার তৃণমূল বিধায়ক মহঃ আলী। তারানগরের মানুষ যদিও কংগ্রেসেই ভরসা রেখেছেন গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে।
ভাঙন দুর্গত তারানগরের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, “জন প্রতিনিধিরা এখন আসছেন, যখন সব শেষ হয়ে গেল। এখন এসে কী করবেন। দিন পনের আগে থেকে এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে পদ্মা। এতদিনে হুঁশ ফিরল?” আর এক বাসিন্দা হুমায়ুন কবীর বলেন, ” এর আগে বিডিও সাহেবকে বলা হয়েছিল পার বাঁধানোর জন্য। ওরা কোনও গুরুত্ব দেয়নি। সেদিন বিডিওর গাড়ি ঘেরাও করা হয়েছিল। কথা দিয়েছিল কাজ করে দেওয়া হবে। এখনও সেই কাজ শুরু হয়নি।”
আরও এক বাসিন্দা আব্দুল জাহির বলেন “বালির বস্তা পাঠিয়ে এই কাজ হয় না। বাংলাদেশ যেমন ঢালাই করে পাকা কাজ করেছে সেইরকম কাজ করলে পার এভাবে ভাঙবে না।” কাকে বলেছেন সে কথা? জাহির বলেন, ” কাকে বলব? নেতারা আসছে দেখছে ওরাই টাকা খাচ্ছে।” বিধায়ক অবশ্য বলছেন, “দরপত্র ডেকে ইতিমধ্যেএলাকায় ভাঙন রোধের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।” ভাঙা পারে কারা যে গোটা কতক বাঁশ ফেলে গিয়েছেন তা অবশ্য জানেন না এলাকাবাসী।

দিন কয়েকের এই ভাঙনে পার লাগোয়া বেশ কিছু গাছ ভেঙে গিয়েছে। আর একটু এগিয়ে বিএসএফ চেক পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেলে নিচু জায়গায় পদ্মার পার মিশে গিয়েছে জমির সঙ্গে। আতঙ্কিত জিয়াউল বললেন, “আরও জল বাড়লে এই দিকের আরও কয়েকশো বিঘে জমি জলের তলায় চলে যাবে।”

প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীও গিয়েছিলেন ভাঙন এলাকা দেখতে। পার থেকে এগিয়ে এসে গ্রামের মধ্যেই একটি অস্থায়ী মঞ্চ করা হয়েছিল। সেখান থেকে এলাকার মানুষজনকে ত্রাণ সামগ্রী বিলিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গিপুরের প্রার্থী মুর্তজা হোসেন (বকুল)। সেই মঞ্চ থেকেই অধীর কেন্দ্রের সেচমন্ত্রী সি আর পাতিলের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন উপস্থিত গ্রামবাসীকে শুনিয়েছেন। পরে অধীর অবশ্য বলেছেন মন্ত্রী তাঁকে লিখিতভাবে পরিস্থিতির কথা জানাতে বলেছেন। মানুষজন অবশ্য বলছেন, “এখন ওই চিঠি চালাচালিই হোক। নদী ততক্ষণে যা করার করে নিক। ওদের আর কী?”
খুব সুন্দর প্রতিবেদন।
পুরোটা কভার করা হয়েছে।
আর শেষ লাইনটা……
একদম সপাটে শট 👍👍👍