দুর্গাপুজোর গ্রামীণ আনন্দে আজও মিশে আছে সম্প্রীতিই

Social Share

স্নেহাশিস সৈয়দঃ দুর্গাপুজো একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবে পরিচিত হলেও এই পুজোকে কেন্দ্র করে যে শারদোৎসব তা বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। মহালয়ার পরেই বাতাসে ভেসে ওঠে ঢাকের আগমনীবার্তা। এই সময়টা গ্রামীণ মানুষের জীবনে আর্থিক দুঃসময় হলেও আপামর জনসাধারণ কি হিন্দু, কি মুসলিম-সবাই উৎসব বলে গ্রহণ করেছিল। যদিও এই পুজোকে উপলক্ষ্য করে গ্রামবাংলা ও শহরভিত্তিক মানুষের জীবনে বাঙালি বৈশিষ্টগুলো প্রতিফলিত হয়।

মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে গ্রামীণ সংস্কৃতি একসময়ে পুজো উপলক্ষে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে উঠতেন পুজোকে কেন্দ্র করে। জেলার কান্দি মহকুমার গোকর্ণ, কান্দি, খড়গ্রাম, জঙ্গিপুরের রঘুনাথগঞ্জ, সাগরদিঘি ,লালবাগ, লালগোলার গাবতলা, বাহাদুরপুর, কালমেঘা, হোসনাবাদ প্রভৃতি এলাকায় এই সম্প্রীতির ছবি ফুটে উঠে ।

এই উৎসবকে উপলক্ষ্য করে মুসলিম বাড়িতেও হিন্দু বাড়ির মতো ঘর পরিষ্কার করা হয়, নিকানো হতো উঠোন। মুসলিম মহিলারাও ব্যস্ত হয়ে উঠতেন মুড়ি-মুড়কি,নাড়ু তৈরিতে।

সপ্তমীর কাকভোরে ঢাকের বাজনার সঙ্গে নবপত্রিকা বা কলাবৌ কে গঙ্গায় স্নান করতে নিয়ে যাওয়া হতো। আর তা দেখতে রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন মুসলিম বাড়ির মহিলা সহ অন্যরা। আরতির শেষে সারি গায়কের দল নেচে নেচে পার্বনি আদায় করতো। এরা ছিল জাতিতে মুসলিম। বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময় প্রতিমার অলংকার নেওয়ার জন্যে জলে ঝাঁপিয়ে পড়া কিশোরদের কোনো ধর্ম ছিল না, আজও নেই । ধর্মের স্বাদ-গন্ধহীন সে এক অন্য প্রতিমার অঙ্গভরণ লুন্ঠন। গ্রামের দূর -দূরান্ত থেকে আসা উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বিসর্জনের মেলায় সারা দিয়ে দোকান -পসরা সাজিয়ে বসেন। বিভিন্ন গ্রামের লোকেরা মেলায় অংশ নিয়ে ঢাকের বাজনা পেছনে ফেলে দশমীর চাঁদ মাথায় রাত করে ঘরে ফিরে যান।

কান্দির বাসিন্দা বিজয় কুমার রায় জানান, গ্রামীণ পুজোতে এই সম্প্রীতি আজও অটুট রয়েছে ।এখনও দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো দেখতে মণ্ডপে পাশাপাশি ভিড় করেন। আশীর্বাদ নেন। তবে সময়ের সঙ্গে সেই আবেগটা কমেছে। তার জন্যে আর্থিক দিকটা অনেক বেশি দায়ী। এই মহকুমায় যতগুলো পুজো হয় তাতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এসে ভিড় করেন। তারা না এলে যে পুজোর দিনগুলো ফ্যাকাসে ,ভীড়হীন হয়ে যাবে। এ উৎসবের আগাগোড়াই যে মানুষ জড়িয়ে আছে । গোকর্ণর বাসিন্দা বৃদ্ধ অঘোর মুখার্জী জানান, অবশ্যই গ্রামের থেকে শহরের পুজোর ভাবভঙ্গি আলাদা ।

সেখানে বিজয়া দশমীর কোনো তাৎপর্য নেই, দশমীর চাঁদও সেভাবে উপভোগ করা যায় না। যা আছে তা প্রতিযোগিতা, আলোর উচ্ছাস। তবে তা সর্বজনীন । শহরের বাসিন্দারা আড়ম্বরতায় হারিয়ে যেতে চায়, সেখানে নেই আন্তরিকতা। আলোর রোশনাই নিজেদের ভাসিয়ে দেয মানুষ। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ,অন্য সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি জেনে তাদের একাত্ত্ব করতে দেখা যায় না। তাই সম্প্রীতির নজির সে অর্থে মেলে না। আর্থ -সামাজিক -রাজনৈতিক নানা কারণে সেসবের পরিবর্তন হয়েছে ।গভীর রাতে বিসর্জন সেরে ঘরে ফেরা লোকজনের কথা, পায়ের শব্দ মোহিত করে না শহরবাসীদের । অন্যদিকে ,পুজোর দিনগুলো শহর আলোয় মোড়া, দশমীর চাঁদ উপেক্ষিতই থাকে।

আরও পড়ুনঃ সেনেদের পুজো দেখতে মানুষ আসেন প্রাণের টানে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights