অন্য রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র নামেই। কাজে দেখাতে হলে তাঁদের মমতাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।

বিদ্যুৎ মৈত্রঃ নবান্নের বৈঠকে কারা জিতলেন ? রাজ্য সরকার না কি জুনিয়র চিকিৎসকরা। এর উত্তর ব্যক্তি বিশেষে এক এক রকম হবে। তবে একথা সবাই মানবেন সোমবারের বৈঠক ছিল অভিজ্ঞ রাজনীতিকের সঙ্গে নবীন রাজনীতিকদের স্নায়ু যুদ্ধ। দু-পা এগিয়ে দু-পা পিছিয়ে ৪৫ মিনিটের বদলে দু-ঘন্টা দু-পক্ষের টানটান ম্যাচ শেষ হল। রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠক শেষে অনশন তুললেন জুনিয়র চিকিৎসকরা, মঙ্গলবারেও হচ্ছে না রাজ্য জুড়ে চিকিৎসক ধর্মঘট। ম্যাচ পকেটে পুরে আপাতত স্বস্তি সরকার পক্ষের। তবে স্বস্তির নায়ক কে মনোজ পন্থ না কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা এখন তামাম দর্শকদের আলোচনার বিষয়।
তবে সব রাজ্যের চিফ সেক্রেটারির ভূমিকা এক হলেও মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা সব রাজ্যে এক নয়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে প্রযোজ্য। এই একটি নামে ইদানিং একজন মানুষকে চিনে যায় ভারতের বাকি ২৭টি প্রদেশ। দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ যেখানেই যাবেন শুনতে পাবেন ” ও আপনি মমতাদি’র লোক।” একটা সময় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবও এমন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বাসে, ট্রেনে, টেম্পোতে। আকাশপথে, জলপথে সর্বত্র। কেউ ব্যঙ্গ করে, কেউ ভালবেসে, কেউ সুবিধা নিয়ে, কেউ সুবিধা না পেয়ে, যেভাবে মানুষ আরও যা কিছু ছড়ায় নিজের স্বার্থমতো, সেভাবেই। নীতিশ কুমার সেই জনপ্রিয়তা এখনও অর্জন করতে পারেননি।
সোমবার পাক্কা দু-ঘন্টা এগারো মিনিট এগারো সেকেন্ডের একটু বেশি ১৭ জন চিকিৎসক প্রতিনিধির সঙ্গে নবান্নে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠক কী নিয়ে হওয়ার কথা ছিল? কথা ছিল চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সহ রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের আমূল পরিবর্তন নিয়ে একটি সদর্থক আলোচনার। ৯ অগস্ট থেকে হঠাৎ করে বদলে গিয়েছে রাজ্যের হাওয়া। টানা একমাস সেই হাওয়া এতটাই প্রবল ছিল, এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল শাসকের তরী। প্রয়োজন ছিল শক্ত ও অভিজ্ঞ মাঝির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দায়িত্ব পালন করেছেন দলের ক্ষেত্রে একইভাবে রাজ্যপাটেও। একথা তাঁর ঘোর বিরোধীও (শুধু বিপরীত রাজনৈতিক শিবির নয়। মমতা সমোলোচিত হয়েছেন তাঁর দলেও) স্বীকার করবেন।
কিন্তু কোন পথে তিনি আটকালেন রাজ্য জুড়ে সর্বাত্মক চিকিৎসক ধর্মঘট? নরমে গরমে তিনি গোটা তিলোত্তমা পর্ব এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন শুরু থেকে। প্রথম দিকে বিরোধীদের খোলা মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। বিরোধীরা ডিফিডেন্ট কী পেয়েছেন? মমতা জানেন এই লড়াই তাঁকে জিততে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্র, রেশন ক্ষেত্র সহ একাধিক ক্ষেত্রের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সরকার ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে। তাঁর কাছের দুই মন্ত্রী এখনও জেল বন্দী। নাগাড়ে বিরোধীরা তাঁর দলের কুঁচো নেতা থেকে বড় মাথাদের বিরুদ্ধে সেই অস্ত্রে শান দিয়েছেন, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়। কিন্তু টলাতে পারেননি। বিরোধীদের ভাঁড়ার তাই শূন্যই।
তবে অন্য সব কিছুর থেকে চিকিৎসকদের আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এই রাজ্যের মানুষ যে কার্যত একটি লাইনে দাঁড়িয়ে এক স্বর হয়ে উঠবেন ১৪ অগস্ট, রাজ্যের অতিবড় সমালোচকও টের পাননি। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেছে। তেল, সলতে আগুনের ব্যবস্থা ডিওয়াইএফ আইয়ের ছেলেরা করলেও তা কার্যত কেড়ে নিয়ে (এসইউসিআই ? ) অতি বিপ্লবী চেহারায় জুনিয়র চিকিৎসকরা সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। একসময় মনে হয়েছিল গদি টলে গেল। তা হয়নি।
উল্টে একজন ‘দিদি’র ভূমিকায় নেমে প্রয়োজনমতো জুনিয়রদের ‘শাসন’ করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন চাইলেই সব পাওয়া যায় না। চাইলেই তিনি গদি ছাড়তেই পারেন কিন্তু জনতার রায় নিয়ে আসতে হবে। যে যাই বলুন, সেই আত্মবিশ্বাস তাঁকে জুগিয়েছে গ্রাম বাংলা। একইসঙ্গে তাঁর হাতে থাকা ২৯ জন সাংসদও পরোক্ষে বিজেপি বা ইন্ডিয়া ব্লক কাউকেই দুঃসাহসী হতে দেয়নি। অধীর চৌধুরী দাপালেও রাহুল গান্ধী এই পর্বে নরেন্দ্র মোদিকেই বিরোধী ভেবেছেন। সেদিক থেকেও মমতা নিশ্চিন্ত ছিলেন। সামনেই ছ’টি উপনির্বাচন। তাঁর চাই জয়ের ধারা অব্যহত রাখা।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একাধিক প্রকল্পের সুবিধা শহরের মানুষ যা নেয়, তার থেকে গ্রামের মানুষ সেই প্রকল্পের উপরেই নির্ভরশীল। গ্রামে গ্রামে বিরোধী দলের ছাতার আড়ালেও অনেকে তৃণমূল করেন। এমনকি গ্রামের অনেক নামজাদা বিরোধী রাজনীতিকও কোনও না কোনওভাবে ওই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। মুখে বললেও সরকারের সেই প্রকল্পকে উপেক্ষা করতে পারেন না তাঁরা। গ্রামের হাটে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তড়িৎগতিতে ছুটে আসে উত্তর ” তাঁর আগে সরকার কোথায় ছিলেন।”
ঊর্ধসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে রাজ্যের বেকারত্ব, গ্রামের প্রধান-উপপ্রধানদের আকন্ঠ দুর্নীতি, দল বুঝে প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়াও একশ্রেণির আমলা ইদানিং ভাল রপ্ত করেছেন। আমলাদের দুর্নীতিও কম নেই এ রাজ্যে, সেই সুযোগও তাঁরা সর্বোচ্চ স্তরের সবুজ সিগন্যালেই পেয়েছেন। বিশেষ করে বিডিও স্তরের আধিকারিকরা, এমন মত দলেরও একাংশের। সবকিছুকে এক দিকে রেখে গ্রাম কিন্তু মমতার পক্ষেই থেকেছে গত ১৩টি বছর। মমতাও প্রয়োজন মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দলের নেতাদের ক্ষমতায় এনে কখনও ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে ( সবাইকে সুযোগ দিতে ?) মানুষকে বুঝিয়েছেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’। মমতাই গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরেছেন।
কলকাতার মতো অত্যাধুনিক মহানগরে চলা শিক্ষিত সমাজের এই ধারাবাহিক আন্দোলনের মোকাবিলাতেও মমতা নজর রেখেছেন গ্রামের দিকেই। আজকের বৈঠকেও তিনি তাঁর অনশনের ২৬ দিনের প্রসঙ্গ তুলেছেন। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এমন একাধিক প্রসঙ্গ তুলেছেন। বৈঠকের রাশ নিজের হাতে রাখতে অসাড় কথা বলেছেন। লম্বা হয়েছে বৈঠক। আর অন্যদিকে তথ্য হাতে নিয়ে দাবি আদায়ের জন্য মুখ সুরসুর করতে থাকা চিকিৎসকরা ঠাই বসে থেকে শুনেছেন সে সব।
চিকিৎসক অনিকেত মাহাত একসময় সহকর্মীদের বলেই দিয়েছেন “শুনলে তো বলব “। তাঁদের রাগ হয়েছে। কিন্তু উল্টাতে তো পারেনইনি। মমতাকে পাল্টাতেও পারেননি। তিনি আষাঢ়ে গল্পের আড়ালে, হিমঘরেই ঠেলেছেন দুর্নীতির কথা। স্বাস্থ্যের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পাশেই থেকেছেন। দিদির সুরে ভাইদের অনশন তুলতে বলেছেন। কাজে ফিরতে বলেছেন। যিনি প্রয়োজনে ইংরেজিতেও বক্তব্য (?) রাখেন সেই তিনি মমতা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে চাওয়া জুনিয়র চিকিৎসককে বাংলায় বলতে বলেছেন। বলেছেন “আমি ইংরেজি বুঝি না”। ( ‘আটপৌরে’ তকমাকে ঝালিয়ে নিলেন ? )
উনি জানেন এই বৈঠকের দর্শক সারা বিশ্বের সঙ্গে গ্রামীণ বাংলাও। এমনকি তাঁর অনুমতি ছাড়া আগামী দিনে স্বাস্থ্যের কি শিক্ষায়, কি পরিষেবায় কোনও বদল আনতে কেউ পারবেন না, এমনই মত দিয়েছেন। তিনি জানেন চিকিৎসকরা ধোয়া তুলসি পাতা নন। এক সন্দীপ ঘোষের জেল যাত্রা ও শিক্ষক চিকিৎসকদের নাগাড়ে দুর্নীতি উপরে ফেলার দাবিকে প্রকারান্তরে জিইয়ে রেখে নিজের হাতে রাশ টেনে মমতা সোমবারও বোঝালেন এখনও রাজ্যের শেষ কথা তিনিই। তিনিই বিরোধী, তিনিই শাসক। অন্য রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র নামেই। কাজে দেখাতে হলে তাঁদের মমতাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি সেটা আপাতত মুশকিল নয় অসম্ভবও।