বিদ্যুৎ মৈত্র, মুর্শিদাবাদঃ একে মেয়ে, তার ওপর ফুটবলের মতো বডি গেম। নৈব নৈব চ। শুরুতেই হোঁচট খেয়েছিল উদ্যোগ। পড়শি মহলের এইমত তিনি বিশ্বাস করেননি। লকডাউনের ধু ধু মাঠেই মেয়ে সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে দৌড় প্র্যাক্টিস করাতেন বাবা নুরুজ্জামান শেখ। মেয়ের আগ্রহ দেখে তাঁকে সুরজ সর্দারের কাছে নিয়ে যান। সুরজের বাবা সমীর সর্দার জেলার পুরনো খেলোয়ার। দু’জন কোচের পরামর্শেই মেয়ে ফুটবলে পা দেয়। সেই শুরু। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অ্যাথলেটিক্সে সঙ্গে ফুটবলেও নিজেকে তৈরি করেছে রাজিয়া।

বহরমপুর ব্যারাকস্কোয়ার মাঠে সুব্রত মুখোপাধ্যায় কাপের মহকুমাস্তরের চুড়ান্ত পর্যায়ে বিপক্ষ বাজারসৌ হাইস্কুলের মেয়েদের একটা একটা করে ছ’গোল দিয়ে শনিবার ধরাশায়ি করেছে রামনগর হাইস্কুলের মেয়েরা। রামনগরের দলে ছিল রাজিয়া। সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের সেই কথা গুলোই মনে পড়ছিল বাবা নুরজামানের। বললেন, ” স্কুল সেইভাবে কোনও উৎসাহ দেখায়নি। আমরাই এলাকার মেয়েদের নিয়ে একটা টিম তৈরি করেছিলাম, যারা সবাই ওই স্কুলের ছাত্রী। তারাই আজ স্কুলের নাম ছড়ালো মহকুমায়।”

জেলায় লোকসভা নির্বাচনের আগে শুরু হয়েছে অনূর্ধ ১৫ ও অনূর্ধ ১৭ ছেলেমেয়েদের ৬৭ তম সুব্রত মুখোপাধ্যায় কাপের মহকুমাস্তরের টুর্নামেন্ট। বহরমপুর মহকুমাতেও শনিবার শেষ হয়েছে এই টুর্নামেন্ট। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল ফর স্কুল গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস এর উদ্যোগে প্রতি বছর এই টুর্নামেন্ট হয়। কোভিডকালে অবশ্য বন্ধ ছিল। আগামী সপ্তাহে জেলা স্তরের টুর্নামেন্ট হবে। নুরুজ্জামানের বিশ্বাস রামনগর হাইস্কুল জেলা চাম্পিয়ন হবে। তারপর ক্লাস্টার পর্যায়ের খেলা। পরে রাজ্য স্তরের টুর্নামেন্ট। “মেয়েদের রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখা হয়ত বেশি বলা হয়ে যাচ্ছে। তবে মেয়েদের পায়ে ভালো শট আছে। যদি তা হয়ে যায় তাহলে এর থেকে আনন্দের আর কী আছে?” বলছিলেন নুরুজ্জামান।

এই টুর্নামেন্টের সব খবরই তাঁর কাছে আছে। ছেলেদের দলও ভাল খেলেছে। নুরুজ্জামানের আক্ষেপ, ছেলেদের খেলাধুলোকে এখনও স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়। কিন্তু মেয়েরা যেন খেলতেই পারে না। গ্রামবাংলার এই বিশ্বাস আস্তে আস্তে ভাঙছে, এটা ভরসার। তাঁদের গ্রামেও রিজিয়াদের পরেও অনেক মেয়ে খেলার মাঠে আসবে বলছিলেন তিনি। বলছিলেন, “লেখাপড়ায় মুর্শিদাবাদের মেয়েরা আগেই রাজ্যজয় করেছে। এগোবে খেলাধুলাতেও।”
তবে রামনগর স্কুলের মেয়েদের খেলার ব্যপারে আগ্রহ না থাকলেও বাজারসৌ হাইস্কুল খেলাধুলোয় মেয়েদের পাশে আছে। স্কুলের শিক্ষক শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল বলছিলেন তাঁর স্কুলের মেয়েদের ফুটবল দল তৈরির নেপথ্য কাহিনী। বলছিলেন , ” বহুদিনের ইচ্ছে ছিল মেয়েদের ফুটবল খেলার মাঠে নামানো।” কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষকতার দরুণ এলাকার মানুষের হাবভাব তাঁর চেনা। তাই অপেক্ষা করতে হয়েছে বাড়ির কাছে বদলি হওয়া পর্যন্ত। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ” বাজারসৌতে এসেও মেয়েদের ফুটবল খেলার কথা বলবার সাহস ছিল না। পাছে পরিবারের মানুষজনের আপত্তি থাকে।”

অথচ ছেলেমেয়েদের অ্যাথলেটিক্সে নিয়ে যেতেন জেলার বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু ফুটবল বা কবাডিতে নামতে বাড়ির লোকেদের ঘোরতর আপত্তি থাকে বলে জানাচ্ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। বলেন,” নিজের এলাকা বলে একবার উদ্যোগ নিলাম। স্কুলের অদূরে পিডব্লিউডি’র মাঠে একদিন ফুটবল খেলার কথা পারলাম ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের কাছে। দেখি এলাকার মানুষও সেই প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়েছেন। আস্তে আস্তে একটি টিম তৈরি হল। মাত্র ছ’মাস হল ওরা জনা পনের ষোল নিয়মিত খেলা প্র্যাক্টিস করে।” তবে সেই পারফরমান্সে যে টুর্নামেন্ট খেলবে মেয়েরা সেই মনের জোর শিক্ষকেরই ছিল না। বললেন, “মেয়েরাই খেলতে চাইল। আর আটকায় কে? চাম্পিয়ন না হোক রানার্স তো হয়েছে। এটাও তো বিরাট পাওনা।”

বহরমপুর মহকুমায় শুক্রবারের খেলায় গোরাবাজার আইসিআই স্কুল অনূর্ধ ১৭ বিভাগে চাম্পিয়ন হয়েছে। বিপক্ষ দাদপুর হাইস্কুলকে এক শূন্য গোলে হারিয়েছে আইসিআইয়ের ছেলেরা। জেলাস্তরেও ওরা ভাল ফল করবে বলে বিশ্বাস ওই স্কুলের শিক্ষক সুবোধ মণ্ডলের। একইভাবে অনূর্ধ ১৫ বিভাগে সরযূবালা বিদ্যাপীঠ দুই শূন্য গোলে চোয়া বিবিপাল হাইস্কুলকে হারিয়ে চাম্পিয়ন হয়েছে।

শনিবার ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই খেলা হয়েছে। সেই খেলা ঘিরে ক্লান্তি ছিল না ছেলেমেয়েদের। বরং উৎসাহ ছিল চোখে পড়বার মতো। আয়োজকদের পক্ষ থেকে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। মাঠে প্রস্তুত ছিল অ্যাম্বুলেন্সও। দুপাশে সার দিয়ে ছেলে মেয়েদের খেলা দেখেছেন বাবা মায়েরা। যাদের ছেলে মেয়েরা জিতেছে তাদের বাবা মায়েরা পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। যারা এই খেলায় জিততে পারেনি তাদের বাবা মায়েদের কেউ কেউ বলেছেন, “পাসটা যদি ঠিক করে দিতে পারতিস তাহলেই গোলটা হয়ে যেত।” যা শুনে মজার ছলে আর এক অভিভাবক বলে উঠলেন “তাও ভাল ওরা অন্তত জানে সেম সাইড গোল কাকে বলে। আমাদের তো গুলিয়ে যেত।”
আরও পড়ুনঃ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীই