
লিটন শেখ, ডোমকলঃ চাপা পড়া দেওয়াল থেকে দেহাংশ তুলতে গিয়ে শিউড়ে উঠেছেন মুর্শিদাবাদের পোড় খাওয়া পুলিশও। বোম বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন সাগরপাড়ার সাহেবনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের খয়রাতলার তিন জন। ওই পঞ্চায়েত এলাকার ধনীরামপুরে বাঁশ বাগানের মধ্যে একটি দোতলা বাড়িতে বোমা বাঁধার কাজ করছিলেন মামুন মোল্লা, সাকিরুল সরকার ও মুস্তাকিন শেখ। আর সেই বোম ফেটেই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে ওদের দেহ।
খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছে পাকা বাড়িটাও। বাড়িটি মামুন মোল্লার। কেন এই ঘটনা ঘটল? উত্তাল বাংলাদেশের কোনও প্রভাব সীমানাঘেঁষা সাগরপাড়ায় পড়ল কি না তা নিয়ে ধন্দে পড়ে যান এলাকাবাসী। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কি না তা নিয়েও ধোঁয়াশায় ছিলেন আমজনতা।
রবিবার রাত এগারোটা নাগাদ খয়রাতলায় ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন ঘুমে ঢুলছে সাহেবনগর। বোমার বিকট আওয়াজে বাড়ির বাইরে এসে প্রথমে এসব কিছুই ঠাওর করতে পারেননি মামুনের প্রতিবেশিরা। ওই বাড়ির আশেপাশের মানুষজন বললেন ” বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে দেখছি ধোঁয়া আর কুয়াশায় একাকার। স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাতাসে শুধু বারুদের গন্ধ।”
ততক্ষণে পাকা বাড়ির গ্রিল বেঁকে গড়িয়ে পড়েছে দেওয়াল, গুঁড়িয়ে গিয়েছে ছাদ। যারা যারা ওই তিন জনের রক্তাক্ত দেহ দেখেছেন তারা বর্ণনা দিতে গিয়েই শিউড়ে উঠছেন সোমবার সকালেও। বলছেন, “চেনা মুখগুলোকেই অচেনা লাগছে। কারও দু-হাত, কারও পা উড়ে গিয়েছে। শরীর গুলো ঝলসে গিয়েছে আগুনে।”
ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে মুস্তাকিনের। বছর ২৬-এর সাকিরুল ও বছর ২৪ এর মামুন মোল্লাকে ঝলসানো অবস্থায় রাত বারোটা নাগাদ মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাত দুটো ঝলসে গিয়েছিল মামুনের। সাকিরুলের ক্ষতবিক্ষত হাত দুটো চিকিৎসকরা কোনওরকমে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বাঁচানো যায়নি।
কিন্তু কী করে হল এত ভয়ংকর কান্ড ? পুলিশ বলছে বোমা বাঁধার কাজ চলছিল রুদ্ধদ্বার ওই বাড়িতে। অসাবধনতাবশত তা ফেটে যাওয়ায় এই বিপদ। ওই বাড়িতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ কেজি সুতলি বোমের মশলা মজুত করা ছিল। তারও বেশি তো কম নয়। সেই মশলা থেকেই এতবড় বিস্ফোরণ বলে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান। যার ফলে বাড়ির দেওয়াল, ছাদ, জানলা, দরজা আসবাবপত্র ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এরা বোমা সরবরাহের কাজ করত বলে পুলিশের দাবি।
তবে এলাকার বাসিন্দাদের এক অংশের অনুমান, বাইরে থেকে কেউ ওই বাড়িতে বোম ফেলতে পারে। আর সেই প্রসঙ্গেই সন্ত্রাসের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ। যদিও সেই অনুমান উড়িয়ে দিয়ে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “বাইরে থেকে বোম ছোড়া হলে বাড়ির হাল এইরকম হত না। এটা অনুমান মাত্র। বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই।”
নরসিংহপুরে সাকিরুলের কাপড়ের দোকান আছে। মৃতরা তিনজনেই দিনের বেলায় অন্য কাজ করলেও তারা ছিল অন্ধকার জগতেরই বাসিন্দা। এদের অতীত ইতিহাস বলছে অপরাধ জগতের সঙ্গে বিশেষ করে পাচারের কাজেও জড়িয়ে ছিল তিনজনই। বাড়িঘর দুয়োরও সেই বেআইনি রোজগারেই করা বলে দাবি। মামুনের দিদি অবশ্য বলেন, ” ভাই কেরালায় কাজ করত। বাবার অসুস্থতার পর এলাকায় ফিরে আসে।” তবে এলাকায় সে বোমা বাঁধার কাজে হাত পাকিয়েছিল কি না তা তিনি জানেন না বলেও দাবি করেছেন সংবাদমাধ্যমের সামনে। পুলিশ গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে। থমথমে এলাকায় টহল দিচ্ছে পুলিশ।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর গোটা রাজ্য জুড়েই সক্রিয় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। বোমা উদ্ধার বা বোমা বিস্ফোরণের খবরের সঙ্গে বারবার নাম জড়িয়েছে মুর্শিদাবাদের। ভোটের আগে হোক, কিংবা এমনি সময়েই বারবার মায়েদের কোল ফাঁকা হয়েছে এই জেলায়। আবারও ফিরল সেই ছায়া মুর্শিদাবাদে।