
বিতান মুখোপাধ্যায়, বহরমপুরঃ স্নেহাশিষ ভট্টাচার্য রচিত ও বিপ্লব দে নির্দেশিত নাটক ‘নির্জন রাখালে’র পটভূমি প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং তার বর্ণবৈষম্যপীড়িত সমাজ। যেকোনো প্রাচীন সভ্যতার অতীতকে গৌরবের আলোতে দেখবার যে অভ্যাস, তাকেই পুনর্বিবেচনা, যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে নাটককার সুচারুভাবে বেছে নিয়েছেন এই প্রেক্ষাপট। নিম্নবর্গীয়, পিতৃপরিচয়হীন সত্যকামের শিক্ষা গ্রহনের অধিকার মহাভারতের একলব্যের মতো এখানেও স্বীকৃতি পায় না।

ভগ্নমনোরথ একলব্য নির্জন বনমধ্যে গুরু দ্রোণাচার্যর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে অস্ত্রশিক্ষা শুরু করে। আর জ্ঞানপিয়াসী সত্যকাম আচার্য গৌতমের নির্দেশ মেনে শুধুমাত্র শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্যে বেছে নেয় এক গভীর নির্জন পথ। এখানে প্রকৃতি তার সমস্ত রঙ-রূপ-গন্ধ নিয়ে এগিয়ে এসে সত্যকামকে জ্ঞানের পথে উন্নিত করে। আসলে আত্ম-উন্মেষের ইচ্ছা, সংকল্প, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম একসাথে মিলেমিশে গেলে কোনোকালেই বর্ণবৈষম্য, ধর্মের ভেদাভেদ, জাতিগত বিবাদ, ইত্যাদি জ্ঞানার্জনের পথে যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি, তা ইতিহাস বারবার প্রমাণ দিয়েছে। সেযুগেও, এযুগেও। ইতিহাসের থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি, সেটা আমাদের ব্যর্থতা।

বহুদিন পর ঋত্বিক এমন মনোমুগ্ধকর নাটক মঞ্চস্থ করল বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে, যা বহুদিন মনে থাকবে। মফঃস্বলের মঞ্চে দেখা এই নাটক কলকাতার তাবড় নাট্যদলকে ভাবতে বাধ্য করবে শুধু অভিনয়ের দক্ষতা দিয়েই নয়, আদ্যোপান্ত পেশাদার মানসিকতায় রবিবার সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয়েছে “নির্জন রাখাল”। নির্দেশক সকল কুশিলবের থেকেই যথাযথ অভিনয় বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে সত্যকাম চরিত্রটি যে অতলস্পর্শী আবেগ দাবি করে, তাকে অভিনেতা অনেকাংশেই ছুঁয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। আলো ও মঞ্চসজ্জাও আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে।
নাটকের বৃহৎ অংশ জুড়ে যেহেতু প্রকৃতি কখনো তার নির্জন প্রান্তর, গহিন অরণ্য, বিষণ্ণ দিগন্ত-সীমানাকে বারংবার হাজির করেছে, তাই আলো, আবহ এবং মঞ্চসজ্জায় সৃজনলীতার যথেষ্ট ছাপ না থাকলে নাটক-পটভূমির এই কল্পনির্মান দর্শকমনে অধরাই রয়ে যেত। আলোকশিল্পী ও মঞ্চশিল্পীর যৌথ প্রয়াস তা হতে দেয়নি।
বহরমপুরের ঋত্বিক বাংলার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার। প্রখ্যাত নাট্য সমালোচক অংশুমান ভৌমিক এদিন মঞ্চে বলেছেন, ” দেশ বিদেশের নাট্যমেলা হওয়ার জন্য যে আকাঙ্খা এই দলটির আছে তা এই বাংলার অন্য কোনও দলের নেই।” সেই কথার মর্যাদা রেখেছে ঋত্বিকের মোহিতবন্ধু অধিকারী, শিপ্রা সেন, রাজেশ সাহা, জয়দেব তরফদার, মহুয়া চক্রবর্তী, বিপ্লব দে প্রমুখরা।