লোকসভায় বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বহরমপুরের সাংসদ ত্রিদিব চৌধুরী, ১৯৬৪ সালে। ১৯৭১ সালে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশ।

বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অত্যাচারের কথা উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগুরুদের এই অত্যাচার কী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই ঘটছে ? বাংলাদেশে এই ঘটনা কী প্রথম? কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বর্তমান বিজেপি সরকারের সমালোচনা করে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি পাকিস্তানকে দায়ি করেছেন।
তবে এই ঘটনা ২০২৪ এই ঘটেছে এমন নয়। বাংলাদেশ গঠন হওয়ার আগে থেকেই সে দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটে পাকিস্তানের মদতে। ভারত ভাগ হওয়ার পর থেকেই ঘটছে। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া পাকিস্তান সেই সময়েও চায়নি পূব বাংলা অধুনা বাংলাদেশে হিন্দুরা নিশ্চিন্তে বসবাস করুক। আর তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ভারতের নেতারা। আজ থেকে ৬০ বছর আগেও একইভাবে অস্থির ছিল বাংলাদেশ।

১৯৬৪ সালে লোকসভায় এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন বহরমপুরের সাংসদ ত্রিদিব চৌধুরী। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার চলত তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাঁকে জানিয়েছিলেন আর এক বিপ্লবী নেতা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। ওই সূত্র ধরে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে বিষয়টি মানবতার প্রশ্নেই রাষ্ট্র সংঘে উত্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ত্রিদিব। সেই সময় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর পাকিস্তানের অত্যাচারের কথা তিনি রাষ্ট্র সংঘকে জানাতে বলেছিলেন, যাতে বিশ্ব পাকিস্তানের মানসিকতা সম্পর্কে জানতে পারে।
১৯৬৪ সালের ২১ মার্চ যুগান্তর পত্রিকায় সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিরোনাম করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাষ্ট্র সংঘে উত্থাপনের প্রস্তাব। নিচে লেখা হয়- ঈশ্বর ও মানবতার নামে ত্রিদিব চৌধুরীর আহ্বান। ওই সংবাদে লেখা হয়-” পূর্ব পাকিস্থানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার যে প্রচণ্ড আঘাত ঘটিয়াছে পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় কতৃপক্ষ সমগ্রভাবে পূর্ব পাকিস্থানের জনগণকে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে যেভাবে বঞ্চিত করিতেছেন ভারত সরকার রাষ্ট্রসংঘে সেই প্রসঙ্গ তুলুন, বিশ্বের কাছে পাকিস্থানের সেই আচরণ উদ্ঘাটন করুন। ” (বানান অপরিবর্তিত)। এই প্রস্তাব উত্থাপনের পাশাপাশি বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ সেদিন লোকসভায় এটাও বলেছিলেন, “সরকার সংখ্যালঘুদের ভারতে আগমনের পথে সমস্ত বাধা অপসারণ করুন।”
তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ওপার বাংলায় অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের এপারে ঠাঁই দিতে নারাজ তো ছিলই, এমনকি সেই সময় বিরোধীদের এই দাবি পরোক্ষে বিষয়টিকে উৎসাহ দান হিসেবেই দেখতেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। সে কথা উল্লেখ করে ত্রিদিব চৌধুরী সেদিন এটাও বলেছিলেন, ” এটি উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপার নয়। তাহাদের যদি সম্মান লইয়া বাঁচিতে হয় তবে চলিয়া আসা ছাড়া তাহাদের আর কোনও উপায় নাই।” যুগান্তরের দিল্লি সংবাদদাতা এটাও লিখেছিলেন, ” কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি আঙ্গুল দেখাইয়া তিনি বলেন, তাহাদের উদ্ধার করা আপনাদের কর্তব্য। ঈশ্বর ও মানবতার নিকট আপনারা এই কর্তব্যের ঋণে ঋণী।”
ত্রৈলোক্যনাথ পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের যে বিবরণ দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটি বই লেখা হয়ে যেতে পারে বলেও সেদিন ত্রিদিব চৌধুরী লোকসভায় দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ” লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ডের বিবরণ দিয়া একটা গোটা বই লেখা চলে। পাকিস্তানী রাইফেলবাহিনীর লোকেদের হাতে সংখ্যালঘুদের যেভাবে হেনস্তা হইতে হয় তাহা অকথ্য। তাহারা ছাতা খুলিয়া যাইতে পারে না। রাইফেলধারী সৈন্যদের দেখিলেই কুর্ণিশ করিতে হয়। সৈন্যদের শিবিরে মেথরের কাজও তাহাদের দিয়া করানো হয়।”
আইনসভায় দাঁড়িয়ে সেদিন আরএসপি নেতা ত্রিদিব চৌধুরী বলেছিলেন, ” সংখ্যালঘুদের প্রতি আমরা সহানভূতি দেখাইয়াছি, পাকিস্থানী অত্যাচারের নিন্দা করিয়াছি, কিন্তু বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য কিছুই করি নাই।” অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায় সেদিন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সংসদে বলেছিলেন, ” পাকিস্থান সংখ্যালঘুদের জিম্মি করিয়া রাখিয়াছে, অথচ এমন ভাব দেখাইতেছে যেন তাহারাই আহত পক্ষ। এই দুষ্টামি ফাঁস করিয়া দেওয়া উচিত।” শ্রী প্রফুল্ল রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ” পাকিস্তান যে সংখ্যালঘুদের কি চোখে দেখে তাহা ‘জিম্মি’, ‘কাফের’ কথাগুলি হইতেই বোঝা যায়।” সংবাদের শেষে লেখা হয়, ” কংগ্রেস সদস্যগণের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যেসব পাকিস্তানী অবৈধভাবে ভারতে অবস্থান করিতেছে, তাহাদের বহিষ্কার করা হউক।” তার সাত বছর পর ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
আজ ২১ ডিসেম্বর ত্রিদিব চৌধুরীর প্রয়াণ দিবস। ১৯৯৭ সালে প্রয়াত হন ভারতের এই স্বাধীনতা সংগ্রামী।বাংলাদেশের পাবনা জেলায় ১৯২১ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম তাঁর। লেখাপড়া বহরমপুরে। পরে এই বহরমপুরেরই সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লোকসভার সদস্য। আরএসপি’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ত্রিদিব ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। ১৯৭৪ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হলেও ফররুদ্দিন আলী আহমেদের কাছে হেরে যান।
তাঁর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আরএসপি-র মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটি একটি স্মরণ সভার আয়োজন করে। সেখানে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য বহরমপুরের আর এক প্রাক্তন সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি চারণ করেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু ত্রিদিব চৌধুরীর। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দলের জেলা সম্পাদক অঞ্জনাভ দত্ত, সংগ্রাম সমাজদার, তরুণ নেতা মনোজিৎ চৌধুরী, ছাত্র নেতা রুবেল শেখ প্রমূখ। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন অভিরূপ বিশ্বাস সহ অন্যরা।
৭৫ বছর ধরেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার হয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের উপরে মায়ানমারে অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে যেভাবে হৈচৈ হয়েছে, বিগত নব্বইয়ের দশক থেকে চট্রগ্রামের চাকমাদের মেরে তাড়ানোর ঘটনা সেভাবে আলোচনায় আসেনি। ১৯৪৭-এ অমুসলিম জনসংখ্যা ২৩% ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে, আজ সেটা ৬-৭%, এমনকি নিন্দুকে দাবী করে আসলে নাকি ২%-এর মতো। বাকী ২০%-এর হয় দেশ ছেড়েছে, না হয় ধর্মান্তরিত হয়েছে।
আশ্চর্য হতে হয় দেখে যে পশ্চিবঙ্গের মিডিয়া বা মিডিয়ার দর্শক/পাঠক প্যালেস্টাইন নিয়ে যতো লেখালিখি আলোচনা করেন, তার সিকিভাগও এসব নিয়ে করেন না। হিন্দু বা বৌদ্ধদের অত্যাচারিত হওয়া একান্ত ‘নর্ম্যাল’ সীমান্তের ওপারে। হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে উঠে সবাই আজ জানছে এবং আলোচনা করছে। আর সীমান্তের পশ্চিমের দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা… তার চেয়ে চাঁদে জল আছে কিনা সে হিসাব করা সহজতর।