এই কী তবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জঙ্গিপুর ?

Social Share

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়া শমসেরগঞ্জে

সুব্রত বিশ্বাসঃ আজ পয়লা বৈশাখ। ধুলিয়ান, শমসেরগঞ্জে যেন শ্মশানের নীরবতা। সুতিতে ফিসফাস, থেকে বড় জোড় দুএকবার ভীত বাক্য বেড়িয়ে পড়ছে এই যা। দিন কয়েক ধরে বন্ধ দোকানপাট, ঘরে নেই পানীয় জলটুকুও। সেটুকু আনতেও ঘর ছাড়তে হয়। কিন্তু সেই সাহস আর শক্তিই যেন হারিয়ে ফেলেছেন এলাকার মানুষজন। চারপাশে যেদিকে তাকানো যায় শুধু পুলিশ আর জলপাই রঙের সেনা ছাড়া বাসিন্দা কেউ নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে আড়ষ্টভাবে তৃণমূলের দুই জনপ্রতিনিধি আবু তাহের খান আর আনারুল ইসলাম এলাকায় হেঁটে এলেন সকাল সকাল, যেন কোথাও কিছু নেই। অথচ চাপা কণ্ঠে শমসেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ানের ক্ষত কাঁধে রঘুনাথগঞ্জের মানুষজন বলছেন ” এই দাগ সহজে মুছবে না।”

তাঁদেরই একজন স্কুল শিক্ষক বলছেন, ” বিশ্বাসের দেওয়াল ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছে। একে মেরামত করতে যে সাধনা লাগবে সেই ক্ষমতাটা আজ কারও নেই। আমাদেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। মাত্র কয়েক বছর পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে এই এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন, যিনি পরে দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। আজ বাঙালির বড় আদরের দিন। অথচ বাঙালি হিসেবে আজ নিঃস্ব মনে হচ্ছে।” বললাম আপনি তো পেশায় স্কুল শিক্ষক। নামটা পাঠককে জানাতে অসুবিধা কোথায়। বললেন, ” নামে কী হবে? আমার কথাটা কি সত্যি নয়?”

এলাকায় শিল্পপতি হিসেবে পরিচিত খলিলুর রহমান মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে নিপাট ভদ্রলোক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবেই তাঁকে চেনেন মুর্শিদাবাদের তৃণমূল। সেই খলিলুর ২০২৪ সালে ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩৯.৭৪ শতাংশ। অল্প কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ইনিংস শেষ করেছেন কংগ্রেসের মোর্তাজা হোসেন বকুল। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৩১.২৩ শতাংশ।

রঘুনাথগঞ্জে নেমে যে কোনও কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবেন জঙ্গিপুর ভবন কোনদিকে। মিয়াপুর মোড় থেকে বাম দিকে এগোলেই চিনে নেওয়াও সম্ভব প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এই বাসভবন। বীরভূমের ব্রাহ্মণপুত্র প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রথমবার ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গিপুর আসন থেকে জিতেছিলেন। মুসলিম অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষজন তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে। ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সাংসদ হয়েছিলেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। পরের বার আরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন (৫৪.২ শতাংশ) দেশের রাজনীতির আঙিনায় যাঁর পরিচিতি ছিল কৌটিল্য বলে।

তখন অবশ্য শমসেরগঞ্জ বলে আলাদা কোনও বিধানসভা ছিল না। ছিল অরঙ্গাবাদ। রাজ্যে পরিবর্তনের জমানায় অরঙ্গাবাদ ভেঙে রঘুনাথগঞ্জ ও শমসেরগঞ্জের জন্ম। শমসেরগঞ্জ আর ফরাক্কা চলে যায় দক্ষিণ মালদহ লোকসভায়। যার সাংসদ কংগ্রেসের ইশা খান চৌধুরী। আর মুর্শিদাবাদের দুই বিধানসভা ফরাক্কা আর শমসেরগঞ্জের বিধায়ক যথাক্রমে মণিরুল ইসলাম আর আনারুল ইসলাম তৃণমূলের বিধায়ক।

সেই জঙ্গিপুরে একদল দুষ্কৃতি গত কয়েকদিন ধরে দেশের সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে হিংসার কারণে। নদী ভাঙনের কু-নাম প্রণব মুখোপাধ্যায়ও ঘোচাতে পারেননি যে শমসেরগঞ্জ থেকে, সেই শমসেরগঞ্জ আজ ধর্মের ভিত্তিতে ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গিয়েছে। যা বিশ্বাস হচ্ছে না এলাকার প্রবীণ মানুষদের। প্রশ্ন উঠছে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিশ্বাস যোগ্যতা নিয়ে।

আজ অধীর চৌধুরী এলাকায় যাচ্ছেন। তার আগে বহরমপুরে তিনি বলেছেন, ” স্থানীয়ভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করে ভোটে ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যে যারা এই দাঙ্গা লাগিয়েছে, তারা বুঝতে পারেনি যে এটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দাঙ্গাকারীদের কোনও সম্পর্ক নেই।বাইরের লোকজনকে আনা হয়েছিল, মদ খাইয়ে তাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ”

এই অধীরও আজ মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন সাংসদ। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সংখালঘু অধ্যূষিত জঙ্গিপুরে নিয়ে এসে জিতিয়ে পরোক্ষে তিনিই হয়েছিলেন জয়ের কারিগর। শেষ লোকসভা নির্বাচনেও আবদুস সাত্তারের ঘরের ছেলে বকুলকে দাঁড় করিয়ে মাস্টারস্ট্রোক দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতির সমীকরণটাই বদলে গিয়েছে। মানুষের থেকে ধর্ম এগিয়ে গিয়েছে বিশ হাত। যত দিন গিয়েছে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়া এতটাই গ্রাস করেছে মানুষকে যে একগ্লাস জল খেতেও দ্বিধা লাগে… সেই ভরসা ফিরবে কবে ? ফেরাবে কে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights