কল্পনার অতীত— একটি উলট-পুরাণ ন্যারেটিভ

Social Share

তুহিন শুভ্রঃ মনে করা যাক এমন একটি দুনিয়ার কথা, যেখানে জন্মের নাম হলো মৃত্যু। আর মৃত্যু হলো জন্ম। অর্থাৎ মৃত্যু থেকে জীবনের শুরু। আর জন্মে এসে জীবনের শেষ। মৃত্যু-মুহূর্তে ভূমিষ্ট হয়ে ক্রমশ বার্ধক্য, যৌবন, কৈশর, শৈশব অতিক্রম করে মাতৃগর্ভের অন্ধকারে ঢুকে যাওয়াই জীবনের অন্তিম ও অনিবার্য ঘটনা। ধরা যাক, এইরকম একটা টাইম-রিভার্স সাইকেল বা উলট-পুরাণচক্রে আমরা ঢুকে পড়েছি। যেখানে ঘড়ির কাঁটা ঘোরে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে। সূর্যাস্ত দিয়ে দিনের শুরু হয়ে দিন শেষ হয় সূর্যোদয়ে। যেখানে হোমো-স্যাপিয়েন্স উল্টোদিকে হেঁটে যায় হোমো-নিয়েন্দারথ্যালেন্সিস হয়ে হোমো-ইরেক্টাসের দিকে।

যেখানে স্মৃতিধর হয় তিরস্কৃত আর বিস্মৃত-মস্তিষ্ক হয় সম্মানিত বা পুরস্কৃত। যেখানে মধ্যমেধার জয়জয়কার। যেখানে ভুলে যেতে পারাটাই সম্মানের, আর মনে রাখতে পারাটাই ব্যর্থতা। যেখানে ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়াটাই এগিয়ে যাওয়া। যেন ‘এগিয়ে থাকে, এগিয়ে রাখে’ বলার মধ্যে নেই কোনো গর্ব বা অহঙ্কার, ‘পিছিয়ে থাকে, পিছিয়ে রাখে’ বলার মধ্যেই আছে আসল বাহাদুরি। অথচ এসবের মধ্যেই আছে এমন একজন, যে এই পিছিয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। পিছিয়ে যাবার বদলে যে এগিয়ে যেতে চায়। ভুলে যাওয়ার বদলে যে সবকিছু মনে রাখতে চায়। মনে রাখেও। কেননা সিস্টেম সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়াতে বিশ্বাসী।

ভুলিয়ে দিতে পারলে তবেই সিস্টেমের স্বস্তি। আর এখানেই বাধে দ্বন্দ্ব। ব্যক্তির সাথে সমাজের দ্বন্দ্ব। স্বাভাবিকের সাথে সংকটের দ্বন্দ্ব। মনোজগতের সাথে বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। এমন দুনিয়া কি সত্যিই কল্পনার অতীত? না, বোধ হয়। এই দুনিয়ার সাথে খাপ না খাওয়া, এক্কেবারে বেমানান একটি স্বত্ত্বা বা এনটিটি হলো টুকাই। দেশ-বিদেশের তাবড় সভা-সেমিনার, পুরস্কার-সম্মাননার যাত্রা পেরিয়ে বয়সের উল্টো হিসেবে টুকাই এখন এগারো বছরের কিশোর। টুকাই-এর চারপাশ তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে চাইলেও সে কিচ্ছুটি ভোলে না। ভোলেনি।

মেজোরিটির অপ্রেশন তার মুখ বেঁধে দিলেও সে কথা বলতে চায়। কথা বন্ধের ‘স্টেরয়েড’ তার শরীরে ইঞ্জেক্ট করিয়ে দিলেও, সে অন্তত শব্দ করে। নির্বাক হয়ে গেলেও সে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় না। তার পারিপার্শ্বিক সমাজের ভাঙা-গড়া, মানবজাতির বিবর্তন, রাজনীতির পালাবদল, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের চূড়ান্ত বিশ্লেষণ— সে সবকিছু মনে রেখেছে। যা কিনা তার সম-সময়ের কাছে স্বাভাবিক নয়। তাই তাকে একই সাথে নজরে রাখে ডাক্তার এবং শাসকের পুলিশ।

এমনই এক আপাত জটিল, মনস্তাত্বিক বিষয় নিয়ে নাটককার দেবাশিসের রচনা ‘কল্পনার অতীত’। এই সময়ের বাংলা থিয়েটারে নাটকের বিষয়, প্রেক্ষিত, পটভূমি, আঙ্গিক, মঞ্চ, টাইম-স্পেস, আলো, শব্দ, এমনকি নৈশঃব্দ নিয়ে যে ক’জন নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে দেবাশিস অন্যতম এবং অগ্রগন্য। এই নাটকের মুখ্য চরিত্র টুকাই-এর ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার। তাঁর অভিনয় দক্ষতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যেকোনো চরিত্রে তিনি তুড়ি মেরে ঢোকেন, আবার বেরিয়ে যান। অভিনয় করাটা যেন এতটাই সহজ একটা ব্যপার!

এই নাটকের মঞ্চ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্থির, স্থিতিশীল থাকে। মাতৃগর্ভের অন্ধকারে প্রবেশ করবার মতো একটি বড়ো কাপড়ের ফোকরের মধ্যে গ’লে যাওয়া, আর শেষ দৃশ্যে দেওয়াল লিখন ছাড়া মঞ্চ অপরিবর্তীতই থেকে যায়। এমনকি বিরতিতেও কার্টেন পড়ে না, মঞ্চ থাকে উন্মুক্ত। আসলে এই নাটকের ন্যারেটিভ-ই সবচেয়ে বড়ো চমক। তাই বাড়তি কোনো চমৎকারিত্বের প্রয়োজন হয় না। হ’লে তা গুরুপাক হতে বাধ্য। নাটকের সময়কাল বিগত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক থেকে শুরু হয়ে গত দশকের বাংলার জমি আন্দোলনকে ছুঁয়ে ফের সত্তরের দশকে এসে থামে।

নাটককার সমকালীন নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম, আদর্শ বিচ্যুত রাজনীতি, এবং সর্বক্ষেত্রে মধ্যমেধার বাড়বাড়ন্তকে যেমন বিদ্রুপে বিঁধেছেন, তেমনি “সত্তরের দশক মুক্তির দশক, সত্তরের দশক ভালোবাসার দশক”— এই উচ্চারণে সত্তরের দশককে গ্লোরিফাই করতেই চেয়েছেন কী? নাটককারের কাছেই এই প্রশ্নটুকু রাখা থাক।

ছবিঃ সংগৃহিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights