
সংবাদ হাজারদুয়ারি ওয়েবডেস্কঃ বহরমপুরের প্রাচীন স্কুল কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের একাদশ শ্রেণির একাংশ অকৃতকার্য পড়ুয়াকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালন কমিটির সভাপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে পাশ করিয়ে দ্বাদশ শ্রেণির ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এমনই বিতর্কিত অভিযোগ ওই স্কুলের একাংশ পড়ুয়ার।
ওই স্কুলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে পড়াশোনা হয়। স্কুল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে ৭২ জন পড়ুয়া আর কলা বিভাগে ৮২ জন পড়ুয়া পরে। চলতি মাসের সাত তারিখ স্কুলের একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সিমেস্টারের ফল প্রকাশিত হয়। চল্লিশ নম্বরের সেই পরীক্ষায় নূন্যতম ১২ নম্বর পেতে হবে। যাঁরা তার কম নম্বর পাবে তারা অকৃতকার্য পড়ুয়া বলে গণ্য হবে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিমাদ্রী চৌধুরীর দাবি, বিজ্ঞান বিভাগের সকল পড়ুয়াই কৃতকার্য হয়েছে। কিন্তু কলা বিভাগের ২২ জন পড়ুয়া অকৃতকার্য হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ” বাংলা বা ইংরেজির মতো বিষয়ে কোনও একটিতে পাশ নম্বর না পেলে সেও অকৃতকার্য পড়ুয়া বলে গণ্য হবে। ”
সুরজ শেখ নামে ওই স্কুলের একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া সেই তালিকায় আছে। সুরজের অভিযোগ, অন্য অনেক পড়ুয়া ফেল করলেও তাঁদেরকে স্কুল পাশ করিয়ে দিয়েছে। সকলেই আজ দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে পাশ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে সুরজের মা শালিয়ারা খাতুন বিবি দিন কয়েক ধরে প্রধান শিক্ষকের কাছে দরবার করেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক বারবারই তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন বলে সুরজের বাবা সিরাজুল শেখের দাবি।
বুধবার তাঁরা শোনেন স্কুল কয়েকজন পড়ুয়াকে পাশ করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তিও হয়েছে। সে কথা শোনার পর সিরাজুল ও শালিয়ারা ছেলেকে নিয়ে স্কুলে আসেন। ফের প্রধান শিক্ষককে পাশ করানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রধানশিক্ষক তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ সিরাজুলের। তিনি বলেন, ” এতদিন কোনও ক্লাসে সে ফেল করেনি। এবারই সে ফেল করেছে। হেডস্যারকে বললাম ছেলেকে পাশ করিয়ে দিলে ওর বছরটা নষ্ট হবে না। যদি তারপরেও ফেল করে তখন না হয় ছাড়বেন না। শুনেছি একাদশ শ্রেণির পাশ ফেল স্কুলের ওপরেই নির্ভর করে।”
প্রধান শিক্ষক তাঁর অনুরোধ না রাখায় তিনি উদাহরণ স্বরূপ এক অকৃতকার্য ছাত্র অরিন্দম হালদারের মার্কশীট তাঁকে দেখান ও প্রশ্ন করেন, ” এই ছেলেটি তাহলে ফেল করেও পাশ করল কী করে?” সিরাজুলের অভিযোগ, সেই কথায় প্রধান শিক্ষক রেগে যান ও উভয়ের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে যায়। উত্তেজিত পরিস্থিতিতে অসুস্থ হয়ে পরেন সুরজের মা। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে অন্য শিক্ষকরাও ছুটে আসেন। কান্না ভেজা গলায় সিরাজুল বলেন, ” আমি প্রধান শিক্ষককে বলি আমার ছেলেতো আপনাদেরও। সে তো ভুল ঠিক আপনাদের কাছেই শিখেছে। তাহলে তার ভুলকে সংশোধন করে দিলে ছেলেটার বছরটা নষ্ট হয় না।”
সুরজের বাবা এরপর খাতা দেখতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তাঁকে টিসি (স্কুল ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) দেওয়ার হুমকি দেন বলে সিরাজুলের অভিযোগ। যদিও প্রধান শিক্ষক সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ” কয়েকজন ছাত্র কেউ ইতিহাসের, কেউ সংস্কৃত, কেউ এডুকেশন বিষয়ের প্রজেক্ট জমা দেয়নি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের প্রাপ্ত নম্বরের জায়গায় কাউন্সিলের পোর্টালে অনুপস্থিত লেখা হয়েছিল। কিন্তু পোর্টাল থেকে যখন মার্কশীট আসে তখন দেখা যায় তারা ফেল করেছে। ইংরেজিতে absent না লিখে সেখানে নূন্যতম শূন্য লিখলে ওই ছাত্রটি পাশ করে যাচ্ছে। এই বিষয়ে সহ শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে কাউন্সিলে ওইরকম কয়েকজন ছাত্রের নাম লিখে মেইল করা হয়। কাউন্সিলের অনুমতিক্রমে আজ পোর্টালে সেটাই আপডেট করলে ওরা পাশ করে যায়। বিষয়টা ওদের বুঝতে অসুবিধা হয়েছে।” সংসদের নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনও পরীক্ষার্থী প্রজেক্ট জমা না দেয় তাহলে সেই পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য বলেই গণ্য হবে।
অরিন্দমের পাশ করার ক্ষেত্রে হিমাদ্রী বাবুর যুক্তি “ডেটা এন্ট্রি করতে গিয়ে ১২-র বদলে দর্শনে দুই দেওয়া হয়। সেটা সংশোধন করে দেওয়া হলে ওই ছাত্রটি পাশ করে যায়।” প্রধান শিক্ষকের সেই যুক্তি মানতে নারাজ অকৃতকার্য পড়ুয়ারা। তাঁদের কারও কারও দাবি, ” প্রধান শিক্ষক ও পরিচালন সমিতির সভাপতিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাউকে পাশ করিয়েছে কাউকে ফেল করিয়েছে।”
স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল বলেন, ” শিক্ষকদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কোনও ছাত্র ফেল করলে সে ফেল বলেই গণ্য হবে। কিন্তু একটাও ফেল করা ছাত্র যদি ক্ষমতাবলে পাশ করে যায় তাহলে বাকিদেরও পাশ করাতে হবে।”
স্কুল পরিচালন কমিটির সভাপতি অকৃতকার্য পড়ুয়াকে যে পাশ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন তা অবশ্য স্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক। যদিও তিনি বলেন, ” একজন পড়ুয়াকে পাশ করানোর কথা বলেছিলেন সভাপতি। কিন্তু ওই পড়ুয়াকে পাশ করানো হয়নি। সভাপতির কথা রাখা সম্ভব হয়নি।” কারও মন রাখতে নয়, প্রাচীন এই স্কুলের পড়ুয়ার মান ধরে রাখতে পাশ ফেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান হিমাদ্রীবাবু।
পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি অধ্যাপক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য অবশ্য বলেন, ” একাদশ শ্রেণির দুটি সিমেস্টারের পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা স্কুলের দায়িত্ব। কিন্তু স্কুল একবার যে নম্বর আপলোড করেছে তাই ফাইনাল, সেটা পরে আর সংশোধন করা যায় না। এইরকম কিছু ঘটে থাকলে স্কুল সেই সংশোধন পোর্টালে নম্বর তোলার আগেই করেছে।”
একাদশের ফলাফল দ্রুত বেড় করতে সময় বেঁধে দিয়েছিল সংসদ। ১৪ এপ্রিলের মধ্যে একাদশ শ্রেণির চুড়ান্ত ফলাফল জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। পরে তা বাড়িয়ে ১৯ এপ্রিল করা হয়েছে। কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের একাদশ শ্রেণির ফল বেড়িয়েছে ৭ এপ্রিল। হাতে এখনও সময় আছে। সেই সময়ের মধ্যেই অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের নম্বর বদলিয়ে পাশ নম্বর পাঠানো হতে পারে সংসদে, দাবি জেলার শিক্ষক মহলের একাংশের।