স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে মহালয়ার রূপকথা  শৈশবের  দিন 

Social Share

তুষার ভট্টাচার্য, বহরমপুরঃ প্রতি বছর মহালয়ার দিনে স্মৃতির আয়নায়   নরম মেঘের ভেলায় ভেসে এক লহমায় উড়ে আসে ফেলে আসা শৈশবের রূপকথা দিনের উদ্ভাস l মহালয়ার  রাত্তিরে  মাটির উঠোনের  এক পাশে একটা বড় শিউলি গাছ থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ত সাদা শিউলি ফুল l 

শিশির আর কুয়াশার জাল ছিন্ন করে একটা ‘চোখ গেল পাখি’,  ‘চোখ গেল পাখি চোখ গেল’ ডাক দিয়ে  উড়ে যেত পুব দিগন্তের আকাশপানে l স্বপ্নের মহালয়ার ভোর যে কখন হবে, অনন্ত প্রতীক্ষার শেষ ছিল না সেই সময়ে অর্থাৎ ষাট – সত্তর দশকের শিশু, কিশোরদের l

হঠাত্‍ উঠোনে বসানো পুরনো কাঠের ক্যাবিনেটের মস্ত বড়  রেডিওতে ফর ফর করে একটা বিকট আওয়াজ মুহূর্তে সবাইকে সচকিত করে তুলল ; আট থেকে আশি সবাই মাদুর, শতরঞ্চি বিছিয়ে বসে পড়ল নীরবে l কারও মুখে কোনও কথা নেই l

সবাই স্পিক্টি নট l

একজন বয়স্ক মানুষ (অর্থাৎ বাড়ির বড়কর্তা নতুন ধুতি পরিহিত ) বেঢপ সাইজের কাঠের রেডিওর পাশে জ্বেলে দিলেন কয়েকটা ধূপকাঠি l  বাড়ির বড় গিন্নী বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে পেতলের থালায় বাতাসা, নকুল দানা ,শিউলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিলেন ভক্তির উপাচার l এক লহমায় রেডিওটা যেন দেবতায় রূপান্তরিত হয়ে গেল সবার কাছেই। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কচি কাঁচারা কানে কানে ফিস ফিস করে অনুচ্চস্বরে কথা বললেই বড়রা ধমক দিচ্ছে তর্জনী তুলেl একেবারে কড়া মিলিটারি শাসন l

গোটা পাড়ায় জমিদার বাড়িতে ,একটা মাত্রই রেডিও l তাই প্রায় মাঝরাত থেকেই উঠোনজুড়ে পাড়া পড়শিদের ভীড় উপচে পড়েছে ; সবাই বসবার জায়গাও পায়নি l অগত্যা অনেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আনাচে কানাচে l যেমনটা হয় নাটক দেখতে গেলে, যাত্রাপালা দেখতে গেলে lআর এই মাহেন্দ্রক্ষণেই কিনা মস্তবড় রেডিওটায় শুধু বিকট আওয়াজ হচ্ছে ফর — ফর –ফর !

অথচ এই সেকেলে মহার্ঘ যন্ত্রটা সকালেই সারিয়ে আনা হয়েছে l বাড়িতে এনে দশ বারো বার বাজিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে l তবু আসল সময়েই কোনও কথা বলছে না l সবাই টেনশনে কাঁপছে l কী  হয় ,কী হয় ভাব সবারই চোখে মুখে l হঠাত্‍ কলকাতা থেকে আসা বাড়ির মেজ কর্তা রেডিওটায় দু’তিনবার জোরে জোরে থাপ্পড় মারতেই শোনা গেল – ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির ধরণীর বহিরাকাশে  অন্তর্হিত মেঘমালা ——-l’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জাদুকরী কণ্ঠে’ মহিষাসুরমর্দিনীর’ রেকর্ডিং শুনেই  কচি কাঁচা সহ সবার গায়েই কাঁটা দিয়ে উঠলl সেটা ছিল ষাট সত্তরের দশকের ফেলে আসা সব  সোনালি দিনের মধুর স্মৃতি l

তখন আকাশের জানালায় উড়ে যেত  নীল মেঘের ভেলা দূর দিগন্ত পানে l তার দীঘল ছায়া আলপনা এঁকে দিত বাংলার নদ নদী খালবিল হাওরের ফরসা জলে। সেই নীলাম্বরী মেঘের ছায়া দেখে পানকৌড়ি, বালিহাঁস ডুব দিত নদী জলে l পদ্ম, শালুক ফুলে ভরে যেত জলাশয় l দিগন্ত বিস্তৃত ধবল কাশের বনে উড়ে আসত লাল ফড়িং, রঙবেরঙের প্রজাপতির দল l ফসলের মাঠ থেকে গরুর গাড়িতে করে চাষীরা ঘরে নিয়ে যেত  রাশি রাশি পাকা সোনালী ধান, পাটের আঁটি ,বোঝা l 

নীলকণ্ঠ পাখির উড়াল ডানায় চেপে বছর ভর প্রতীক্ষিত স্বপ্নের মহালয়ার দিনও এগিয়ে আসত কচি কাঁচাদের মনের জানালায় l সেই রথ যাত্রার দিন থেকে প্রতিমা তৈরির কারুকাজ দেখতে কুমোর পাড়ায় ভীড় জমতে শুরু করত খুদেদের l মহালয়ার দিনটিই ছিল শৈশবের বাঁধনহারা অনাবিল আনন্দের দিন ; 

মহালয়ার রাত্তিরে জেগে পাড়া পড়শির বাড়ি থেকে নারকেল ,বাতাবি লেবু চুরি করে খাওয়ার আনন্দ ছিল আলাদা রকমের l ইস্কুলের মাঠে পেট্রোম্যাক্স ( হ্যাজাক লাইট) জ্বালিয়ে হত পিকনিকের আয়োজন l মহালয়া মানেই ইস্কুলে ছুটির পর্ব শুরু হয়ে যাওয়া l একদম দুগ্গা পুজো পর্যন্ত পড়া বন্ধ l সেই সময়ে পুজোর জামা কাপড় সবার নাই বা হল তাতে কারও খুব বেশি দুঃখ ছিল না মনে l প্রাণভরা ছিল মনের আনন্দ l

এখনও আকাশে নীল মেঘ উড়ে যায় l শিউলি ফুলের নরম গন্ধ ভেসে আসে শরতের নরম সুমন্দ বাতাসে l ফেলে আসা শৈশবের মহালয়াও স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে নীরবে l দূরের আকাশে উড়ে বেড়ানো  চোখ গেল পাখি  চোখ গেল চোখ গেল বলে ডেকে যায় হৃদয়পুরেl

(লেখক-কবি ও সাহিত্যিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights