
সংবাদ হাজারদুয়ারি ওয়েবডেস্কঃ দিন দুয়েক পরে শুরু হবে বাংলা নতুন বছরের পথ চলা। গাজনের বাজনা শোনা যাচ্ছে মাঠে প্রান্তরে। পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বাঙালি। সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটছে উত্তর মুর্শিদাবাদে। ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরেই উত্তপ্ত সুতি, ধুলিয়ান, শমসেরগঞ্জ। আজ শনিবার সকাল থেকে ফের উত্তপ্ত হয়েছে ধুলিয়ান। সাধারণ মানুষ তো বটেই, আন্দোলনকারীদের হাত থেকে রেহাই মেলেনি শাসকদলের জনপ্রতিনিধি, পুলিশেরও। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে তারমধ্যে একজন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রও রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর নির্দেশ দিয়েছে। আর সেখানেই উঠছে প্রশ্ন?

” এই ঘটনা সাম্প্রদায়িক হানাহানি বা সম্প্রীতি নষ্টের মত কোনও ঘটনা নয়।এখানে হিন্দু মৌলবাদী আর মুসলিম মৌলবাদী শক্তির মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছে।” অভিজিৎ সরকার
তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি সরকার ওয়াকফ আইন সংশোধনের রাস্তায় হেঁটে আজ নতুন আইন বানিয়ে ফেলেছে। বিরোধীতাকে একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটাভুটির নিরিখে অস্বীকার করে প্রস্তাবিত বিলকে আইনে পরিণত করেছেন অমিত শাহরা। আর সেই আইনে কী লেখা আছে? সংখ্যালঘু মুসলিমদের কতটা ক্ষমতা সেক্ষেত্রে খর্ব করা হয়েছে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতির কারবারীদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট আলোচনা তেমনভাবে নজরে পড়েনি। উল্টে প্রতিনিয়ত সমাজমাধ্যমে বেড়ে চলেছে উস্কানি পাল্টা উস্কানি। হুঙ্কারের পাল্টা হুঙ্কারে কাঁপছে বাংলার আকাশ। আর তাতেই হিংসার ঘটনা ঘটছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জেলা মুর্শিদাবাদে। সুতি, ধুলিয়ান, শমসেরগঞ্জও তার ব্যতিক্রম নয়।

“পাঁচ হাত মাটির ভেতরে ঢুকে আছি,জানালা নেই, দরজার তো প্রশ্নই নেই। আলো ঢোকালে চলবে না, বাতাস ঢোকালে চলবে না। আলোবাতাস ঢুকলেই হয় আমরা হয় কেউ হিন্দু কেউ বা মুসলমান।” সুগত সেন
রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দুই দল কেউই তাঁদের ভূমিকা যথাযথ পালন করছেন না বলেই মত মুর্শিদাবাদের বুদ্ধিজীবি মহলে। একই সঙ্গে পশ্চিমবাংলা আজ দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচয় পাচ্ছে ২৬ হাজার চাকরিরত শিক্ষকদের বাতিল হওয়া প্রসঙ্গে। কেউ কেউ মনে করছেন দুর্নীতির হাওয়া ঘোরাতে সচেতনভাবেই সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলা হচ্ছে রাজনীতির আঙিনায়।
প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব অভিজিৎ সরকার বলেন ” এই ঘটনা সাম্প্রদায়িক হানাহানি বা সম্প্রীতি নষ্টের মত কোনও ঘটনা নয়। এখানে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা হচ্ছে বলে আমার ব্যক্তিগত মত। এখানে হিন্দু মৌলবাদী আর মুসলিম মৌলবাদী শক্তির মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছে। প্রশাসনের মাথারা সময়ে উদ্যোগী হলে এতবড় ঘটনা ঘটত না। দ্বিতীয়ত, বিতর্কিত ওয়াকফ আইন বোঝাতে মানুষজন কতটা উদ্যোগী হয়েছে্ সেটার গুরুত্ব কী সেসব আলোচনাই হয়নি। আসলে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন রাজনীতির কারবারীরা।”

” সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই এই কথাটা মানুষকে বোঝাতে হবে। আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের জন্মদিন পালন করছি কিন্তু ওঁরা কত ভাল ভাল কথা বলেছেন সেগুলি মানছি না।” -আবুল হাসনাত
উত্তর মুর্শিদাবাদে বহিরাগতদের আশ্রয়ে এতবড় হিংসার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি পুলিশ সূত্রের। যে কায়দায় লুঠ চলেছে, মানুষ কেটে ফেলা হয়েছে, প্রশাসনকে কার্যত প্রহসনে পরিণত করে ফেলেছেন আন্দোলনকারীরা তাতে সাম্প্রতিক অতীতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণ অভ্যূত্থানের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। এখনও বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার নেই। সোমবার রাত পোহালে নতুন বাংলা বছর শুরু হবে। যা বাঙালির কাছে এক উৎসবও।
মূলত ঐক্য এবং সম্প্রীতির ডাকেই সেদেশে এতকাল মঙ্গল শোভাযাত্রা বেড়িয়েছে পয়লা বৈশাখ সকালে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এবার তার নাম বদলে যাচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে এবার তা উদযাপিত হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের চারুকলা অনুষদ ১৯৮৯ সাল থেকে পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রার আয়োজন করে আসছে। প্রথমে তার নাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ই ছিল, নব্বই দশকে সেই নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল।

” লালনের গানে, সুফি গানে সব জায়গায় মানুষে মানুষে বন্ধনের কথা বলা হয়েছে। ধর্মের মাধ্যমে বিভাজনের কথা বলা হয়নি।”- অনুপম ভট্টাচার্য
সেই ঢঙে ২০১৮ সালে বহরমপুরে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে তৈরি হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা কমিটি। তার উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ সকালে বাঙালির ঐতিহ্যে সুসজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রাও শহর পরিক্রমা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা সুগত সেন বলেন, ” “পাঁচ হাত মাটির ভেতরে ঢুকে আছি,জানালা নেই, দরজার তো প্রশ্নই নেই। আলো ঢোকালে চলবে না, বাতাস ঢোকালে চলবে না। আলোবাতাস ঢুকলেই হয় আমরা হয় কেউ হিন্দু কেউ বা মুসলমান।” লিখেছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অর্থাৎ আমাদের দেশের পরিবেশ হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছে। উত্তর মুর্শিদাবাদে যা দেখা যাচ্ছে সেই বিভাজনের রাজনীতির ফলশ্রুতি।”
তিনি আরও বলেন, ” এই পরিস্থিতিতে মঙ্গল শোভাযাত্রা চেষ্টা করছে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি এবং ঐক্যের একটা আবহাওয়া, একটা পরিবেশ রচনা করবার। কারণ আমাদের শোভাযাত্রায় বঙ্গবাসী পরিচয়ে, বঙ্গভাষী পরিচয়ে হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ হাঁটবেন। মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য, বাঙলার সংস্কৃতি তুলে ধরাই আমাদের অভিপ্রায়।”

” একটি মাত্র শোভাযাত্রার উপর বাঙালির বন্ধন দাঁড়িয়ে নেই বলেই আমার মনে হয়। তবে মিলিতভাবে যে কোনও কাজই হতে পারে বলে আমার মনে হয়।”–কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত
অভিজিৎ বলেন, ” এই উদ্যোগ খুবই ভাল উদ্যোগ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হলে আমরা আরও বড় সর্বনাশের মুখে পড়ব।” অধ্যাপক আবুল হাসনাত বলেন, ” দলমত নির্বিশেষে এই সময় এই ধরনের অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই এই কথাটা মানুষকে বোঝাতে হবে। আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের জন্মদিন পালন করছি কিন্তু ওঁরা কত ভাল ভাল কথা বলেছেন সেগুলি মানছি না। মানুষকে ভালবাসা, মানুষের পাশে থাকাই তো মানুষের কর্তব্য হওয়াই উচিত।”
নাট্যকর্মী অনুপম ভট্টাচার্যও বলছেন ” লালনের গানে, সুফি গানে সব জায়গায় মানুষে মানুষে বন্ধনের কথা বলা হয়েছে। ধর্মের মাধ্যমে বিভাজনের কথা বলা হয়নি। এখন যে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভাজনের কথা বলা হচ্ছে তাকে সরিয়ে মানুষে মানুষে বন্ধন তৈরির জন্যই মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন।”

চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত অবশ্য মনে করেন একটি শোভাযাত্রার উপর বাঙালির বন্ধন দাঁড়িয়ে নেই। তিনি বলেন, ” বাঙালির বাঙালিয়ানার সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলি সাজিয়ে এই শোভাযাত্রা পূর্ব বাংলার পুরনো সংস্কৃতি। এই শোভাযাত্রা যদি কোনও কারণে বন্ধ রাখতে হয় তাহলে খুব ব্যতিব্যাস্ত হওয়ার কিছু নেই। একটি মাত্র শোভাযাত্রার উপর বাঙালির বন্ধন দাঁড়িয়ে নেই বলেই আমার মনে হয়। তবে মিলিতভাবে যে কোনও কাজই হতে পারে বলে আমার মনে হয়।”